তারুণ্য যেন পথ না হারায়

লেখক:
প্রকাশ: ১ মাস আগে

তারুণ্যের আছে উদ্যম, আগ্রহ ও শক্তি। যার জলজ্যান্ত প্রমাণ গত কয়েকদিনের ঘটনাবলী। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণরা সরকারি চাকরির কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্ট কিছু চাওয়া উল্লেখ করে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। চালক কিংবা শাসকের আসনে বসে থাকা গোষ্ঠী সেই দাবির প্রতি খানিকটা অবজ্ঞার সুরে কথা বললেন। তরুণরাও এতে অপমানিত হলেন। বারবার বলার পরও ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলো যখন তরুণদের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ, এবং হয়ে উঠলেন নিষ্ঠুর; তখন তরুণরা ভাবলেন, ‘আর না। কর্তৃত্ববাদীদের হটিয়ে এবার আমরাই নেবো দায়িত্ব।’ এরপর ছাত্র-জনতার দ্রোহের সেই আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়লো দাবানলের মতো। অবশেষে অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থান দেখলো জাতি, যার মাধ্যমে বদলে গেল দৃশ্যপট, উন্মোচিত হলো এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। এবার সেই সম্ভাবনার অন্বেষণ ও প্রত্যাশা পূরণে দেশের একদল জ্ঞানী-গুণী মানুষ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন, সেখানেও তাদের সঙ্গে নেতৃত্বে রয়েছেন তরুণরা।

 

বিষয়বস্তুর প্রেক্ষাপট নিশ্চয়ই বিস্তারিত মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে পৃথিবীর প্রতিটি কোণে থাকা প্রতিটি বাঙালি জানেন, বাংলাদেশে কী চলছে। যারা এতদিন অভিযোগ করতেন, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কেমন যেন, কিংবা যারা বলতেন এই প্রজন্মের প্রত্যেকে ডুবে থাকে কম্পিউটার ও স্মার্টফোনের স্ক্রিনে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ইনবক্স-কমেন্টবক্স ও রিলসে— তারা তাদের ধারণা পাল্টাতে বাধ্য হয়েছেন। একটি বিষয়ে সকলে একমত হয়েছেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সংস্কৃতি এবং ক্রীড়াঙ্গন সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি পরিবর্তন দেখতে হয়, এখনই তার সুবর্ণ সময়। আর তা হবে তরুণদের হাত ধরেই।

যেমন দেখুন, দুদিন আগেও বাজারে যেকোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আকাশচুম্বি দাম নিয়ে মানুষের মাঝে তীব্র অসন্তোষ ছিল। উচ্চমূল্যের নেপথ্যে ছিল রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি। তরুণরা এর বিরুদ্ধেও এবার রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। শিক্ষার্থীরাই বাজার মনিটরিং করছেন, দ্রুত প্রায় সব পণ্যের দাম নেমে এসেছে সাধ্যের মধ্যে। ছাত্র-আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সংঘাত-সংঘর্ষে যে এলাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, শিক্ষার্থীরাই সেগুলো স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সংসদ ভবন সহ বিভিন্ন স্থাপনায় চালিয়েছেন পরিচ্ছন্নতা অভিযান। দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও শিক্ষার্থীরা পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করার মাধ্যমে নিজেদের শহরকে পরিষ্কার করা উদ্যোগ নিচ্ছেন। পুলিশের কর্মবিরতির ফলে যে কদিন ধরে সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণেও চরম বিশৃঙ্খলা হওয়ার আশঙ্কা ছিল, সেটিও সুনিপুণভাবে সামলে নিয়েছেন শিক্ষার্থীরাই। যে জেব্রা ক্রসিংগুলো বছরের পর বছর ধরে কার্যত অকার্যকর ছিল, মানুষ সারিবদ্ধভাবে সেই ক্রসিং ব্যবহার করেই রাস্তা পার হয়েছেন। সড়কে কোনো সিগনাল বাতি না থাকায় নিয়মভঙ্গ করা এবং লেন না মানার যে প্রবণতা ছিল চালকদের, সেটিও নিয়ন্ত্রণ করেছেন শিক্ষার্থীরা। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে এলাকায়-এলাকায় পাহাড়া দিতেও সচেষ্ট ছিলেন তারা। অন্যদিকে যখন সংখ্যালঘুদের মন্দির-গীর্জায় হামলার আশঙ্কার কথা শোনা গেল, সেখানে দিনরাত পাহাড়া দিয়েছেন মাদ্রাসাছাত্ররাও। এছাড়া দেয়ালে-দেয়ালে আঁকা সৃজনশীল-রঙিন গ্রাফিতি তো সকলেই দেখেছেন, যেখানে উঠে এসেছে তারুণ্যের মনের কথা, দেশকে ভালোবাসার ভাষা।

তরুণদের এই উদ্যম নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে সঙ্গত কারণেই তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। আর অভিজ্ঞতা এমনই একটি বিষয়, যা অন্যের কাছ থেকে জেনে, শুনে, ইন্টারনেটে দেখে বা পত্রিকার পাতায় পড়ে আত্মস্থ করা যায় না। নানারকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া এবং বিভিন্ন বিষয় উপলব্ধির মাধ্যমেই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, আর সেই আলোকেই গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হয় —যেখানে অভিজ্ঞতা অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যখন সামনে অনেক সুযোগের হাতছানি থাকে তখন ভুল করার আশঙ্কাও থাকে, তরুণদের এটি মনে রাখতে হবে। একটি বিপ্লব ঘটিয়ে যারা সফল হলেন, সুন্দর আগামীর জন্য সুযোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করতে চাইলে তাদের এখন আরও বেশি পড়াশোনা ও জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। প্রতিটি কাজে ও কথায় পরিশীলিত, সুসংগঠিত, শৃঙ্খলিত ও দায়িত্বশীল হতে হবে। এই উত্তাল সময়ে লক্ষ্য রাখতে হবে, তারুণ্য যেন কোনোভাবেই পথ না হারায়। কারণ, এখন তরুণদের দিকেই তাকিয়ে আছে গোটা দেশ।