তাদের গল্পের শুরুটা শরণার্থী শিবিরে

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

‘যুদ্ধ আমাকে শক্তিশালী করেছে। আমাদের মনোবল ভাঙা অত সহজ না।’ নিজেদের মানসিক শক্তির কথা জানিয়ে ক্রোয়েশিয়া অধিনায়ক লুকা মডরিচ বেশ আগে বলেছিলেন কথাটা। ক্রোয়েশিয়ার প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠা নিয়ে অবকা অনেকে। অবাক ২০ বছর পর তাদের দ্বিতীয় সেমিফাইনাল খেলা নিয়েও। কিন্তু যে দেশের বয়স মোটে ২৭ বছর তাদের দ্বিতীয়বারের মতো সেমিফাইনাল খেলা কি বড় কৃতিত্বের কথা নয়?

অবশ্য তা থেকে আরও চার বছর বাদ দেওয়াই উচিত। কারণ ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটি ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বলকান যু্দ্ধের কারণে অস্থির ছিল ক্রোয়েশিয়া। মডরিচ, রাকিটিচ, পেরিসিচ, লভরেনদের দিন কাটাতে হয়েছে শরনার্থী শিবিরে। ওই যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মডরিচের দাদা।

ক্রোয়েশিয়া ফুটবলারদের মানসিক শক্তি ওই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে। এরপর ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসে ক্রোয়োটরা। এসেই তাক লাগিয়ে দেয় বিশ্বকে। উঠে যায় সেমিফাইনালে। তৃতীয় হয়েই সেবার তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হয়। এরপর আর প্রথম রাউন্ড পেরুতে না পারা অবশ্য বিস্ময়কর। তবে ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রত্যেকটি বিশ্বকাপেই খেলেছে দেশটি। ইউরোপ থেকে প্রত্যেকবার বিশ্বকাপ আসরে যাওয়া পাওয়া অবশ্য মুখের কথা না।

বলকান যুদ্ধের সময় ক্রোয়াট অধিনায়ক মডরিচের পরিবার যাদারের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। তার বাবা ক্রোয়েশিয়া সেনাবাহিনিতে যোগ দেন। যাদারের শরনার্থী শিবিরে থেকেও সেখানে বৃষ্টির মতো বুলেট পড়তে দেখেছেন মডরিচ। মডরিচের মতো হাজারো প্রতিভা তখন ওই গুলির বৃষ্টিতে ভেসে গেছে।

রক্ষণভাগের খেলোয়াড় ভেদরণ করলুকার জন্ম বসনিয়ায়। কিন্তু ১৯৯২ সালে তিনি ক্রোয়েশিয়ায় পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। লভরেনকে পালিয়ে শরনার্থী শিবিরে থাকতে হয়েছে। রাকিটিচ পালিয়ে বড় হয়েছেন সুইজারল্যান্ডে।

এরপরও ফুটবল পাগল দেশ হিসেবে ক্রোয়েশিয়াকে কোন অংশে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানির থেকে কম না। তাদের দেশের ফুটবল উন্মাদনার দিকে তাকালে তা বেশ বোঝা যাবে। আর ক্রোয়েশিয়া যে ক্রীড়ামোদী রাষ্ট্র তার স্বপক্ষে যুক্তি দেয় অলিম্পিকে তাদের ভালো পারফর্ম। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে ক্রোয়েশিয়া পদক জয়ের হিসেবে ১৭তম অবস্থানে ছিল। কানাডা, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকার থেকে অনেক কম জনসংখ্যা নিয়েও এদের ওপরে ছিল ক্রোয়েশিয়া। হ্যান্ডবল, ওয়াটার পোল এবং ভলিবলে বিশ্বসেরা দল ক্রোয়েশিয়ার।

তবে ফুটবলে কেন সাফল্য আসতে এতো দেরি ক্রোয়েশিয়ার? তার জবার দেওয়া শক্ত। তবে যুক্তি হলো ফুটবলের বিশ্ব আসরের শিরোপা জিততে হলে ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভা চাই। মেসি-রোনালদো একক প্রতিভা দিয়ে বিশ্বাকাপ জেতাতে পারেননি। তার জন্য ঈশ্বরের কৃপায় এক ঝাঁক প্রতিভার দরকার আছে। এমনকি আর্জেন্টিনার ২০১৪ বিশ্বকাপ দলটিও ছিল এক ঝাঁক প্রতিভার কিচিরমিচির।

সেই প্রতিভার সমন্বয় এই ক্রোয়েশিয়ার আছে। মডরিচ, পেরিসিচ, রাকিটিচ, মানজুরিক, ভিডা, সুভাসিচদের মিলিয়ে প্রতিভার ঘাটতি নেই এই দলের। যার কারণে ক্রোয়েশিয়ার এই দলটাকে সোনালী প্রজন্ম বলা হয়। সঙ্গে পরিশ্রম করার ক্ষমতা দলটা আলাদা করে নিজেদের প্রমাণ করেছে।

নক আউট পর্বের তিন ম্যাচেই ১২০ মিনিট খেলেছে ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু শারিরীক এবং মাননিক শক্তি হারায়নি। লুকা মডরিচ ছয় ম্যাচে ৬৫ কিলোমিটার দৌড়েছেন। রাকিটিচ তার থেকে কেবল দেড় কিলোমিটার কম দৌড়েছেন সমান ম্যাচে। সঙ্গে জুভেন্টাসের মানজুকিচ, ইন্টার মিলানের পেরিসিচ, লিভারপুলের লভরেন, মোনাকোর সুভাসিচ মিলিয়ে দারুণ প্রতিভার এক দল ক্রোয়েশিয়ার।

আর তাই ক্রোয়েশিয়া দল নিয়ে দেশটির সাবেক কোচ এবং ১৯৯৮ বিশ্বকাপ দলের সদস্য ইগর স্টিম্যাক বলেন, ‘ক্রোয়েশিয়ার দলটি প্রকৃতিগতভাবেই প্রতিভার অধিকারী।’ লুকা ইভানসিচ নামের ক্রোয়েশিয়ার এক নামী ফুটবল ক্লাবের নির্বাহি বলেন, ‘সাফল্যের কারণ হিসেবে আমার মনে হয় খেলোয়াড়দের প্রতিভা, তাদের প্রেরণা এবং কঠোর পরিশ্রম বড় ভূমিকা রাখছে।