২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার পর বিভিন্ন আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে লেকহেড গ্রামার স্কুলের নাম। এবার প্রতিষ্ঠানটির নাম এসেছে জঙ্গিদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করার ঘটনায়। যে ঘটক আইএস যোদ্ধা বাংলাদেশি তরুণ নজিবুল্লাহ আনসারীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় গ্রেফতার বাংলাদেশি তরুণী মোমেনা সোমার বিয়ে ঠিক করেছিল, সেই ঘটক দীর্ঘদিন লেকহেড স্কুলে চাকরি করেছে। তাকে আইনের আওতায় এনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
তদন্তসংশ্নিষ্টদের প্রাথমিক ধারণা, উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিয়ে ঠিক করতে ওই ঘটক দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এ ধরনের কাজের জন্য ওই ঘটকের একটি ম্যারেজ মিডিয়াও রয়েছে।
এদিকে জঙ্গিবাদে জড়ানো মোমেনা ও তার বোন আসমাউল হুসনা সুমনার ব্যাপারে তদন্ত করতে ঢাকায় এসেছে অস্ট্রেলিয়া পুলিশের তিন সদস্যের একটি দল। গতকাল বৃহস্পতিবার তারা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এরই মধ্যে দুই বোনের ব্যাপারে বাংলাদেশ পুলিশ তদন্তে কী পেল তা জানতে চায় অস্ট্রেলিয়া। আবার অস্ট্রেলিয়া তদন্তে কী পেল তা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশ। তদন্তের প্রয়োজনে বাংলাদেশ পুলিশ অস্ট্রেলিয়া যাবে।
২০১৪ সালের শেষ দিকে সিরিয়ায় পালিয়ে যায় আইএস ভাবাদর্শের অনুসারী জঙ্গি নজিবুল্লাহ আনসারী। তার সঙ্গে মোমেনা সোমার বিয়ের উদ্যোগ নিয়েছিল এক ঘটক। তবে নজিবুল্লাহর পরিবার রাজি না হওয়ায় এ বিয়ে হয়নি। গত ৯ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার উত্তর মেলবোর্নে ঘুমন্ত অবস্থায় একজনকে ছুরিকাঘাত করে প্রবাসী শিক্ষার্থী সোমা। অস্ট্রেলিয়ার পুলিশের সন্দেহ, সোমা উগ্রপন্থায় জড়িত। এ ঘটনার পর ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কাফরুলে সোমার বাসায় অভিযানে যায় সিটিটিসি। এ সময় সিটিটিসির সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলামকে ছুরিকাঘাত করে সোমার বোন সুমনা। পুলিশ সুমনাকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তখন বেরিয়ে আসে তারা দুই বোন ‘সেলফ র্যাডিকালাইজড’। তারা নব্য জেএমবির মতাদর্শে বিশ্বাসী।
সিটিটিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, মায়ের অসুস্থতার পর ২০১৪ সালের দিকে নিজেই বিয়ে করতে চায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মোমেনা। এক বান্ধবীর মাধ্যমে তার পরিচয় হয় লেকহেড স্কুলে চাকরিরত ওই ঘটকের সঙ্গে। মোমেনা চেয়েছিল একজন ‘দ্বীনদার’ ব্যক্তিকে বিয়ে করতে। এটা জানার পর ওই ঘটক তার জন্য আইএস যোদ্ধা নজিবুল্লাহ আনসারীকে ঠিক করে। নজিবুল্লাহ তার বন্ধু জঙ্গি গাজী সোহানকে নিয়ে ২০১৪ সালে মিরপুরের একটি রেস্তোরাঁয় পাত্রী মোমেনাকে দেখতে যায়। পাত্রী তার পছন্দ হয়। তবে এ বিয়েতে পরিবারের মত না থাকায় পিছিয়ে যায় সে। বর্তমানে গাজী সোহান কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছে।
কীভাবে মোমেনা জঙ্গিবাদে জড়াল? এ প্রশ্নের উত্তরে সিটিটিসির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ‘ল রেটো’ থেকে ‘ও’ লেভেল ও মাস্টারমাইন্ড থেকে ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করে মোমেনা। এরপর ২০১৪ সালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়। সেখানে পড়ার সময় জঙ্গিবাদ-সংক্রান্ত একটি গবেষণায় অংশ নেয় সে। গবেষণার কাজ করতে গিয়ে দেশি-বিদেশি অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। ধারণা করা হচ্ছে, জঙ্গিদের ওপর কাজ করতে গিয়ে কারও ফাঁদে পড়ে নিজেই জঙ্গিবাদে জড়ায় সে। এরপর ২০১৫ সালে তার মা মারা যাওয়ার পর সে জঙ্গিবাদের দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে। বৃত্তি পেয়ে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার পর এক ঘুমন্ত ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত করতে গিয়ে ধরা পড়ে সে। মোমেনার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে তার ছোট বোন সোমাও জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে।
পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মোমেনা সোমার তদন্তসংশ্নিষ্ট বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। দেশে-বিদেশে পলাতক আর কোন কোন সন্দেহভাজনের সঙ্গে মোমেনা ও তার বোনের যোগাযোগ ছিল তা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। মোমেনা ও সোমার ব্যবহূত বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে সোমা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। বড় বোনের মাধ্যমে সে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে বলে জানায়। তবে এখন তার মনে হচ্ছে জঙ্গিবাদের এ পথ ভুল। এ পথে এসে এখন সে অনুতপ্ত।
লেকহেড গ্রামার স্কুলের অন্তত ২৬ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা হিযবুত তাহ্রীর, আনসার আল-ইসলাম, আলকায়দা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা (একিউএপি), নব্য জেএমবি ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আনসার আল বাইয়্যাত আল মাকদিসের মতো উগ্রপন্থি সংগঠনে জড়িত ছিল। মিরপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামও লেকহেড গ্রামার স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্তে জড়িত থাকার অভিযোগে যুক্তরাজ্যে গ্রেফতার রাজীব করিমও একসময় লেকহেড গ্রামার স্কুলে শিক্ষকতা করত। রাজীব বর্তমানে ব্রিটেনের কারাগারে বন্দি। তার দুই স্বজনের বিরুদ্ধেও জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ আছে। তারা হলো রাজীবের ভাই তেহজীব করিম ও তেহজীবের স্ত্রী সিরাত। তারা দু’জনও লেকহেড গ্রামার স্কুলের শিক্ষক ছিল। ২০১০ সালে ইয়েমেনে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হয় তেহজীব। তেহজীবের শ্বশুর এ রশিদ চৌধুরীও এক সময় লেকহেড গ্রামার স্কুলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছে।
জঙ্গি কার্যক্রমে পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগে গত নভেম্বরে লেকহেড গ্রামার স্কুল বন্ধ করে দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ করে স্কুলটি চালুর নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। প্রতিষ্ঠানটি নির্বিঘ্নে চালানোর ব্যবস্থা করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করানোর দেনদরবার করেন লেকহেডের মালিক খালেদ হাসান মতিন। ঘুষ দেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চমান সহকারী নাসির উদ্দিনকে। এমন অভিযোগে এরই মধ্যে মতিন, মোতালেব ও নাসিরকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।