সূর্য ডুবছে। আরব সাগরের ধারে সি-আকৃতির মেরিন ড্রাইভ সূর্যাস্ত দেখার জন্য মুম্বাইয়ের সেরা জায়গা। গৌধূলী লগ্নের সেই অসম্ভব সুন্দর মুহূর্ত উপভোগ করতে মেরিন ড্রাইভে কত কত মানুষের জটলা। অথচ পাশের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ম্যাচ চলছে সেখানেও এতো মানুষ খুঁজেও পাওয়া গেল না!
দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ব্যাটিংয়ে। কুইন্টন ডি কক ও হেইনরিক ক্লাসেন ঝড় চলছিল ২২ গজে। চার-ছক্কার সমারোহে ওয়াংখেড়ের ক্যানভাস সাত রঙে রঙিন। দুই আম্পায়ারের হাত উঠিয়ে, পাশে নাড়িয়ে বারবার এক্সারসাইজ করতে হচ্ছিল। বাংলাদেশের বোলারদের এলোমেলো করে দক্ষিণ আফ্রিকার আবার রানের পাহাড়ে। আগের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৯৯ রান প্রোটিয়ারা এবার করল ৫ উইকেটে ৩৮২। এ যেন আগের ম্যাচের হাইলাইটস শো চলল ওয়াংখেড়েতে।
শেষবার বিশ্বকাপ মঞ্চ মাতাতে আসা কুইন্টন ডি কক তৃতীয় সেঞ্চুরি তুলে করেন ১৭৪ রান। ক্লাসেন মাত্র ১০ রানের জন্য মিস করেছেন বিশ্বকাপে টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। এছাড়া মার্করামের ৬০ ও মিলারের ৩৪ রানে স্রেফ উড়ে যাওয়ার অবস্থায় বাংলাদেশ। এ রান বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ইংল্যান্ড গত বিশ্বকাপেই করেছিল ৩৮৬ রান।
ওয়ানডে ক্রিকেটে ৩৩৩ রানের বেশি দ্বিতীয় ইনিংসে করা হয়নি বাংলাদেশের। আর ৩২২ রান করে গতবার বিশ্বকাপে জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। তাই আজকের লক্ষ্য বাংলাদেশের জন্য ছিল ইতিহাস ভাঙার, নতুন করে ইতিহাস লিখার।
কিন্তু বোলিংয়ের পর ব্যাটিংয়েও বাংলাদেশ ব্যর্থ হলে সব আশা ভরসা মিলিয়ে যায়। গৌধূলী লগ্নে কক, ক্লাসেন, মিলার ঝড়ে এলোমেলো হওয়া বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে অলআউট ২৩৩ রানে। ১৪৯ রানের জয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা পেল মহামূল্যবান ২ পয়েন্ট। বাংলাদেশ শূন্যহাতে শেষ করলো মুম্বাই সফর।
প্রভাতের সূর্য সব সময় দিনের পূর্বাভাস দেয় না। যদি দিয়ে-ই থাকত তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে শুরুতে যেভাবে চেপে ধরেছিল বাংলাদেশ তাতে রানের পাহাড়ে চড়া হতো না তাদের। আগের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩৯৯ রান তুলে এমনিতেই আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে ছিল তারা। কিন্তু আজ তাদের শুরুটা তেমন জমেনি। শুরুর ১০ ওভারে রান ২ উইকেটে ৪৪। শরিফুল দারুণ এক সুইংয়ে হেনড্রিকসের উইকেট উপড়ে ফেলেন। এরপর হৃদিক রোশনের সিগনেচার মুভ দিয়ে করেন উদযাপন। স্পিনার মিরাজের বল ব্যাকফুটে জোড়া পায়ে খেলতে গিয়ে ডার ডুসেন এলবিডব্লিউ হন।
টস হেরে শুরুতে বোলিং পেয়ে প্রোটিয়াদের এভাবে ধরে রাখবে বাংলাদেশ তা হয়তো কল্পনাতেও কেউ ভাবেনি। কারণ, বৃত্তের সুবিধা কাজে লাগিয়ে প্রোটিয়ারা রান তুলবে জানা কথা। কিন্তু তাদের সুযোগ দেননি বাংলাদেশের পেসার ও স্পিনাররা। ওই ধারাবাহিকতা ছিল পরের দিকেও। দক্ষিণ আফ্রিকা আইডেন মার্করাম ও কুইন্টন ডি ককের ব্যাটে চড়ে শতরানে পৌঁছায় ২০.২ ওভারে। যা এবারের বিশ্বকাপে তাদের দীর্ঘতম।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪২৮ রান করা ম্যাচে প্রথম এক’শ করেছিল ১৭.৩ ওভারে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩১১ রান করা ম্যাচে প্রথম এক’শতে পৌঁছেছিল ১৭.৪ ওভারে। আর কয়েকদিন আগেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১৫.৬ ওভারে দলীয় এক’শ রান পেয়েছিল প্রোটিয়ারা। সেখানে আজ তাদের থামিয়ে রেখে বোলাররা প্রশংসা কুড়িয়েছিল ঠিকই।
কিন্তু বেলা যত গড়িয়েছে ব্যাটসম্যানরাও তত খোলস ছেড়ে বেড়িয়েছেন। দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়েছে তাদের রান। তাতে একটা সময় তাদের ব্যাটে ছিল চার-ছক্কার বৃষ্টি। দৌড়াতে থাকে স্কোরবোর্ড। এক সময় যা নাগালের বাইরে চলে যায়। আর ওই ক্যানভাসে বিবর্ণ হতে থাকে বাংলাদেশের বোলিং। বোলাররা উইকেটে বল ফেলার-ই জায়গা পাচ্ছিলেন না। শেষ ১০ ওভারে ১৪৪ রান তুলে ডি কক, ক্লাসেন, মিলাররা এলোমেলো করে দেন বোলিং আক্রমণ।
দক্ষিণ আফ্রিকার শুরুর ঝড় থামিয়ে রাখতে পারলেও শেষটা পারেনি। মধ্যভাগেও অবশ্য লড়াকু ছিল সাকিব, শরিফুল, মোস্তাফিজরা। ১১-৪০ ওভারে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২ উইকেটে ২৪৩ রান করেছিল তারা। রান রেট ছিল ৮.১। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩ উইকেটে ১৭৯। রান রেট ৫.৯৯। সেখানে মুম্বাইয়ে পরপর দুই ম্যাচে তাদের রান যথাক্রমে ১৯৭ ও ১৯৪। রান রেট ৬.৫৭ ও ৬.৪৬। বিশ্বকাপে চার ম্যাচে তারা আগে ব্যাটিং করে এই সময়ে ৯৫৬ রান করেছে প্রোটিয়ারা। হাঁকিয়েছে ৮৪ চার ও ২৩ ছক্কা। বিশ্বকাপ জিততে এমন পারফরম্যান্সই তো চাই নাকি?
নিজের শেষ বিশ্বকাপে মন খুলে খেলা কক তৃতীয় সেঞ্চুরি পেয়েছেন ১০১ বলে। ডাবলের পথেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন বাঁহাতি ওপেনার। কিন্তু হাসান মাহমুদের নিচু হওয়া এক বল তাকে থামিয়ে দেয়। ১৪০ বলে ১৫ চার ও ৭ ছক্কায় কক সাজান ইনিংসটি।
ইংলিশদের বিপক্ষে ব্যাট হাতে ঝড় তোলা হেইনরিক ক্লাসেন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হবে জানা ছিল। শুরুর দিকে ঠিকঠাক টাইমিং মেলাতে না পারলেও শেষ দিকে পুষিয়ে দেন। ৩৪ বলে ফিফটি পাওয়া এ ব্যাটসম্যান পরের ৪০ রান তোলেন মাত্র ১৫ বলে। হাসানের স্লোয়ার বল কভারের ওপর দিয়ে উড়াতে গিয়ে সীমানায় মাহমুদউল্লাহর হাতে ক্যাচ দেন এই ব্যাটসম্যান।
শেষ দিকে মিলার কেবল ১৫ বল খেলার সুযোগ পান। বড় রানের জন্য ওই বলই যথেষ্ট হয়ে উঠে। ১৫ বলে ১ চার ও ৪ ছক্কায় করেন ৩৪ রান। মাঝে অধিনায়ক মার্করাম ৬৯ বলে ৬০ রানের ইনিংসটিই কেবল এক’শর নিচে স্ট্রাইক রেটে সাজানো ছিল। বাকিরা স্রেফ তছনছ করেছেন বাংলাদেশকে।
বোলিংয়ের পর বাংলাদেশের শুরুর ব্যাটিং ছিল একেবারেই হতশ্রী। আসা-যাওয়ার মিছিলে ব্যস্ত টপ ও মিড অর্ডার ব্যাটসম্যানরা। কারো মধ্যেই লড়াইয়ের কোনো তেজ নেই। নেই টিকে থাকার তাড়ণা। বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতে রান তুলতে হবে। বাড়তি ঝুঁকি নিতে হবে। কিন্তু সেসবের কোনো পরিকল্পনাই চোখে পড়েনি।
লিটন ২৯তম বলে প্রথম সিঙ্গেল নেন। এর আগে ৩ চার হাঁকালেও বাকিটা সময় ধুকেছেন। ওপেনার তানজিদও তাই। ১২ রানে ফেরেন ড্রেসিংরুমে। শান্ত পেয়েছেন বিশ্বকাপের দ্বিতীয় গোল্ডেন ডাক। সাকিব ফেরার ম্যাচে ১ রানে আউট হয়েছেন। মুশফিকের ব্যাট হাসেনি। ৮ রানেই থেমেছে। মিরাজ করেছেন কেবল ১১। এভাবেই একের পর এক ব্যাটসম্যান ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে।
দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে টিকে ছিলেন কেবল মাহমুদউল্লাহ। আগের দুই ম্যাচে নিজের উপযোগিতা দেখিয়েছিলেন। অপরাজিত ৪১ ও ৪৬ রানের ইনিংস খেলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ছন্দে আছেন। ঝাঁঝ না থাকা ম্যাচে বড় স্কোরের সুযোগ উঁকি দিচ্ছিল। সুযোগ কাজে লাগালেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান।
তুলে নিলেন আইসিসি ইভেন্টে চতুর্থ ও বিশ্বকাপের তৃতীয় সেঞ্চুরি। ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন অঙ্ক ছুঁয়েছিলেন। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে আরেকটি সেঞ্চুরি। এবার ভারত বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরি তার ব্যাটেই আঁকা হলো।
১২তম ওভারে মুশফিক আউট হলে ক্রিজে আসেন মাহমুদউল্লাহ। ৪২ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন ধুঁকছিল। দশ ওভারের ভেতরে লিটন ও মিরাজ ড্রেসিংরুমের পথ ধরেন। মাহমুদউল্লাহ হয়ে যান একা। সেখান থেকে নাসুম, হাসান ও মোস্তাফিজের সঙ্গে জুটি বেঁধে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি তুলে নেন।
ফিফটি পেয়েছিলেন ৬৭ বলে। সেঞ্চুরিতে পৌঁছতে খেলেন ১০৪ বল। ৯০ রানে থাকতে কোয়েডজেকে মিড অন দিয়ে ছক্কা উড়িয়ে ৯৬ রানে পৌঁছান। পরের বলে নেন ১ রান। রাবাদার পরের ওভারের প্রথম বল মিড উইকেটে পাঠিয়ে দৌড়ে ২ রান। ৯৯ থেকে শতরানে পৌঁছান ১ রান নিয়ে। সেঞ্চুরি পূরণের পর শূনে্য লাফিয়ে তার উদযাপন বুঝিয়ে দিচ্ছিল বড় কিছুর জন্য কতটা পথ পেরোতে হয়েছে তাকে।
ড্রেসিংরুমে ব্যাট তাক করে সতীর্থদের অভিনন্দনের জবাব দেন। এরপর বার্তা দেওয়া চেষ্টা করেন, ‘আমি কিছুই নই। সব সৃষ্টিকর্তার দেওয়া।’ এরপর সিজদাহ নিজেকে সপে দেন। শেষ পর্যন্ত তার ইনিংসটি থামে ১১১ রানে। যা বাংলাদেশের পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনে ১৪৯ রানে। নয়তো বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানের পরাজয় উঁকি দিচ্ছিল লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের।
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com