স্বামীর বাড়ি থেকে লাল শাড়িতে ঘোমটা পরে সুইটি খাতুন পূর্ণিমা ফিরছিল বাবার বাড়িতে। পাশেই বসেছিলেন তার স্বামী আসাদুজ্জামান রুমন। হাসি-খুশিতে দুটি নৌকায় করে অন্তত ৩৬ জন বৌভাত শেষে রাজশাহীর পদ্মা নদী দিয়ে ফিরছিল। কিন্তু শুক্রবার পদ্মা নদীতে নৌকাডুবি হয়।
আজ শনিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত অন্তত চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ছয়জন। সেই তালিকায় রয়েছেন নববধূ পূর্ণিমাও। তাদের খোঁজে পদ্মাপাড়ে এখন স্বজনদের অপেক্ষা। নববধূর খোঁজে পদ্মাপাড়েই রয়েছেন বর আসাদুজ্জামান রুমন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সামাজিক রীতি মেনে রাজশাহীর পবা উপজেলার ডাঙ্গেরহাট গ্রামের শাহীন আলী তার আদরের মেয়ে সুইটি খাতুন পূর্ণিমাকে তুলে দিয়েছিলেন পদ্মার ওপারের চরখিদিরপুরের বাসিন্দা ইনছার আলীর ২৬ বছর বয়সী ছেলে আসাদুজ্জামান রুমনের হাতে।
বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় বরের বাড়ি থেকে দুটি নৌকাযোগে বর-কনেসহ প্রায় ৩৬ জন যাত্রী ফিরছিলেন কনের বাড়িতে। পথিপধ্যে মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকার বিপরীতে মধ্যপদ্মায় বর ও কনেকে বহনকারী নৌকাটি ডুবে যায়। এ সময় ডুবে যাওয়ার নৌকার যাত্রী আতঙ্কে অন্য নৌকাতে লাফিয়ে উঠতে থাকায় ডুবে যায় অপর নৌকাটিও। এ সময় বালুবাহী ট্রলারের সহায়তায় বরসহ ১৪ জন প্রাণে বেঁচে যান। পরে রাতে আরও বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
নৌকাডুবির ঘটনায় আজ বিকেল ৫টা পর্যন্ত মোট চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা হলেন, একলাস আলী (২২), রতন আলী (৩০), মনি খাতুন (৩৫) ও মরিয়ম খাতুন (৮)। তারা সবাই কনের নিকট আত্মীয় বলে জানা গেছে। আর নিখোঁজরা হলেন, কনে সুইটি খাতুন পূর্ণিমা (১৬), চাচা শামিম হোসেন (৩৫), শামিমের মেয়ে রশ্মি খাতুন (৭), কনের ফুফাতো বোন রুবাইয়া খাতুন (১৩) এবং খালা আখি খাতুন (২৫)। অপরজনের নাম জানা যায়নি।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে রাজশাহীর পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহাদাত হোসেন জানান, শুক্রবার রাতে এ ঘটনায় প্রায় ২৪ জন নিখোঁজ ছিল। তবে রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বেঁচে ফিরেছেন আরও ১৭ জন। এখন সর্বশেষ প্রায় ছয়জন নিখোঁজ রয়েছে।
রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের উপপরিচালক আবদুর রশীদ জানান, শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলে। কিন্তু রাতে কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে শনিবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে আবারও উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে। রাজশাহী, রংপুর ও বিআইডব্লিউটির তিনটি ইউনিট এবং বিজিবির একটি ইউনিট যৌথভাবে পদ্মায় উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে। সকালে উজানের ৫০০ মিটার গভীরে অনুসন্ধান চালানো হয়। দুপুরে ভাটির ৫০০ মিটারে অনুসন্ধান চলছে।
আবদুর রশীদ আরও জানান, মানুষ পানিতে ডুবলে সাধারণত ৩৬ ঘণ্টা পর ভেসে উঠতে শুরু করে। এ জন্য নৌ পুলিশ, মহানগর পুলিশ, জেলা পুলিশ এবং বিজিবি সদস্যরা রাজশাহীর শ্রীরামপুর এলাকা থেকে শুরু করে পদ্মাপাড় ঘেঁষে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে থাকা চারঘাট উপজেলা পর্যন্ত নিখোঁজদের খোঁজে টহল দিচ্ছেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রাজশাহী সদর স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আবদুর রউফ বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত চারটি মরদেহ উদ্ধার করেছি। হিসেব মতে কনেসহ আরও পাঁচজন নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সবাইকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. হামিদুল হক জানান, ভয়াবহ এ নৌকাডুবিতে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলামকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটিকে আগামী দুই দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করছে রাজশাহী জেলা প্রশাসন।