বিসিএস, ব্যাংকসহ সরকারি নানা চাকরির নিয়োগে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে ডিজিটাল জালিয়াতির বড় একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। চক্রটি পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে দ্রুত তা সমাধান করে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীকে সরবরাহ করত। আটক চারজনের কাছে প্রায় ১০ কোটি টাকার নগদ অর্থ ও সম্পদের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সিআইডি প্রধান কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, মো. ইব্রাহিম(২৮), আইয়ুব আলী ওরফে বাঁধন, মো. মোস্তফা কামাল (২৮), মনোয়ার হোসেন(৪২), নরুল ইসলাম (৪৭), হাসমত আলী সিকদার, হোসনে আরা বেগম, গোলাম মোহাম্মদ বাবুল, অলিপ কুমার বিশ্বাস।
নজরুল ইসলাম জানান, এদের মধ্যে অলিপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতির ‘মাস্টার মাইন্ড’। কয়েক বছরে সে জালিয়াতির মাধ্যমে তিন কোটি টাকার বেশি আয় করেছে। ইব্রাহিম, মোস্তফা ও বাঁধন বিসিএসসহ সকল নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির মূল হোতা। অলিপ, ইব্রাহিম, মোস্তফা ও বাঁধন এই চারজনের প্রায় ১০ কোটি টাকার নগদ অর্থ ও সম্পদের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি।
নজরুল ইসলাম বলেন, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেই নয় মেডিকেল, ব্যাংকসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষাতেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে আসছে। সিআইডি শুরু থেকেই এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় গত বছর ১৯ অক্টোবর গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াত চক্র ধরতে অভিযান পরিচালিত হয়। ২০ অক্টোবর শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়। এরপর মাস্টার মাইন্ড নাটোরের ক্রীড়া কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান এছামীসহ এই চক্রের ২৮ আসামি গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আগের রাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূল উৎপাটন করা হয়। ভর্তি কিংবা নিয়োগ পরীক্ষায় মূলত দুই ভাবে জালিয়াতি হয়। একটি চক্র আগের রাতে প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করত। আরেকটি চক্র পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে দ্রুত তা সমাধান করে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীকে সরবরাহ করত। আগের রাতে প্রেস থেকে প্রশ্নফাঁস চক্রের পুরো চক্র চিহ্নিত করা গেলেও ডিজিটাল ডিভাইস চক্রটি বাকি ছিলে।
নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে গেছি। অত্যন্ত সুকৌশল, ধৈর্য এবং নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে নিয়োগ ও ভর্তিতে ডিজিটাল জালিয়াতির সর্ববৃহৎ চক্রটিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এই চক্রটি গত কয়েক বছর ধরে লাখো তরুণের স্বপ্নের চাকরি বিসিএস পরীক্ষাতেও জালিয়াতি করে আসছে। পাঁচ দিনের এক সাঁড়াশি অভিযানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডিজিটাল ডিভাইস চক্রের মাস্টার মাইন্ড বিকেএসপির সহকারী পরিচালক অলিপ কুমার বিশ্বাস, বিএডিসির সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল, ৩৬তম বিসিএসে নন ক্যাডার পদে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত ইব্রাহিম এবং ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিতে উত্তীর্ণ আয়ুব আলী বাঁধনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
এ ছাড়া পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে প্রশ্নপত্র সরবরাহের অভিযোগে রাজধানীর অগ্রণী স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক গোলাম মোহম্মদ বাবুল, অফিস সহায়ক আনোয়ার হোসেন মজুমদার এবং মো. নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই অভিযোগে ধানমন্ডি গভ.বয়েজ স্কুলের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হোসনে আরা বেগম এবং পিয়ন হাসমত আলী শিকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল গ্রেপ্তারের সময় হাসমতের কাছে ওই দিনের বিসিএস লিখিত পরীক্ষার কয়েক কপি প্রশ্নপত্র এবং ৬০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। এই ৯ জনসহ এ মামলায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৭।
গ্রেপ্তারকৃত অলিপ, ইব্রাহিম, বাঁধন ও মোস্তফা জানিয়েছে, কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁসের পর রাজধানীর আলিয়া মাদ্রাসা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের দুটি কক্ষে বসে তারা অভিজ্ঞদের দিয়ে সে প্রশ্নপত্র সমাধান করে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীর কাছে সরবরাহ করত।
এদের মধ্যে ইব্রাহিমের ছিল বিলাসী জীবন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান ইব্রাহিম জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৬তম বিসিএসে নন ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। ৩৬ লাখ টাকার দামি গাড়িতে তার চলাচল। জালিয়াতির টাকায় খুলনার মুজগুন্নী এলাকায় সাড়ে ছয় শতাংশ জমির ওপর চারতলা ভবন নির্মাণ করেছে। নড়াইলে তৈরি করেছে ডুপ্লেক্স বাড়ি। এ ছাড়া অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা করত বলেও সে জানিয়েছে ।
গত কয়েক বছরে বিসিএস, বিভিন্ন ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে শতাধিক ব্যক্তিকে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে ইব্রাহিম।
নজরুল ইসলাম বলেন, এদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে প্রশ্নফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াতি দুটো চক্রকেই সমূলে চিহ্নিত করা গেছে। এই সুবিশাল চক্রকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার ফলে আমরা বিশ্বাস করি আনাগত দিনে ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনা হ্রাস পাবে।