৮ মার্চ দুপুর, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেনটি ৭৫ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলছিল। মীরসরাই উপজেলার পশ্চিম হিংগুলী এলাকার ২০০ মিটার আগে চালক বুঝতে পারেন, রেললাইনে কিছু পড়ে আছে। হঠাৎ দেখেন, এক নারী তার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে শুয়ে আছেন। হাত দিয়ে বাচ্চাটিকে চেপে রেখেছেন। ট্রেনের হুইসেল বারবার বাজাচ্ছিলেন চালক। কোনও লাভ হয়নি। ট্রেনের গতি, দূরত্ব—সব মিলিয়ে থামানোর সুযোগই ছিল না।
এতক্ষণ পড়ে অলৌকিক মনে হলেও, এমনই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের চালক হেমায়েত হোসেন।
‘জীবনে ট্রেনের নিচে অনেক আত্মহত্যা করার ঘটনা দেখতে বাধ্য হয়েছি। তবে এই দৃশ্য খুব মর্মান্তিক ছিল। চোখের সামনে ঘটছে, অথচ কিছু করতে পারছি না। কী যে অসহায় অবস্থা!’— বলছিলেন হেমায়েত।
এসময় হেমায়েতের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে অসহায়ত্ব আর অনুতাপ। এই ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত হেয়ামেত এক ঘণ্টাও ঘুমাননি। বলেন, ‘বাচ্চাটার মুখ দেখছিলাম এক ঝলক। আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। কী যে কষ্ট, বলে বোঝাতে পারব না।’
শিশুসন্তান আর ওই নারী তো বেঁচে নেই? এমন প্রশ্নে হেমায়েত বলে ওঠেন, ‘নাহ। ওই নারীর শরীরে লেগে দ্বিতীয় বগির পাইপ ছিঁড়ে ঘটনাস্থল থেকে ৩০০–৪০০ মিটার দূরে গিয়ে ট্রেনটি থেমে যায়। আমি আশপাশের মানুষকে চিৎকার করে বলছিলাম; মনে হয় বাচ্চাটি বেঁচে আছে, আপনারা আগে বাচ্চাটিকে বাঁচান।’
রেললাইনে শিশুটিকে পড়ে থাকতে দেখে আশরাফুল ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘প্রথম দেখে মনে হয়েছিল, শিশুটি আর বেঁচে নেই। তবে কোলে নিতেই সে কেঁদে ওঠে। শুধু কপালের এক জায়গায় একটু লাল হয়ে ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমত ছাড়া এই বাচ্চাটির বেঁচে থাকার কথা নয়। ট্রেনের শব্দে বা ভয়ে বাচ্চাটি হয়ত অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তা না হলে যদি দাঁড়াত বা নড়াচড়া করত, তাহলে সব শেষ হয়ে যেত।’
আশরাফুল ভূঁইয়া দুই চাচাতো ভাইকে নিয়ে দুটি মোটরসাইকেলে রেললাইনের কাছ দিয়েই যাচ্ছিলেন। দেখেন, ট্রেনটি বেশ জোরে হুইসেল বাজিয়ে খানিক দূরে থেমে যায়। বলেন, ‘আমি যখন যাই, তখন শিশুটির কাছে আর কেউ ছিল না। চারপাশের অবস্থা দেখে মনে হলো, দুর্ঘটনায় অন্য কেউ মারা গেছেন। বাচ্চাটি সুস্থ কি না, সে চিন্তাই মাথায় ছিল। তাই প্রথমেই তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই।’
বাচ্চাটিকে উদ্ধারের পর পরিচয় খুঁজে পেতে ফেসবুকে পোস্ট দেয় আশরাফুলের চাচাতো ভাই জামশেদ। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকের কাছ থেকে ফিরে শিশুটিকে বাড়িতে নিয়ে যাই। বাচ্চাটিকে উদ্ধার করা হয়েছে, কোনও অভিভাবক আছেন কি না- জানতে চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয় জামশেদ। পরে থানা-পুলিশ, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে বাচ্চাটিকে তার নানার হাতে তুলে দেওয়া হয়। এসময় শিশুটির নানিসহ পরিবারের অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।’
এদিকে, ওই নারীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানিয়েছে, পারিবারিক কোনও ঝগড়ার জেরে তিনি সন্তান নিয়ে হয়ত আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। শিশুটির মা ট্রেনচাপায় মারা গেছেন। তবে শিশুটি ট্রেনের নিচে পড়েও অক্ষত অবস্থায় বেঁচে গেছে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল করিম বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা ঘটনা ঘটার পরেই সেখানে যান। ঘটনার পর ওই নারীর স্বামী বা বাবা কোনও অভিযোগ করেননি। তাই অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। আর শিশুটিকে তার নানার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।’
মাজহারুল করিম আরও বলেন, ‘শিশুটির নানার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। শিশুটির বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। ঘটনার দিন ওই নারী স্বামী–সন্তান নিয়ে তার বাবার বাড়িতেই ছিলেন। ধারণা করছি, পারিবারিক কলহের জেরে ওই নারী সন্তান নিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। শিশুটি কার কাছে ভালো থাকবে (বাবা অথবা নানা) সেটি বিবেচনা করা হবে।