জীবন জয়ের দুয়ারে নিভে গেল প্রদীপঃ কুয়েটে তিন দিনের শোক

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

তৌহিদুল, শাহীনের পথ ধরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তাদের প্রাণের দুই বন্ধু হাফিজুর এবং দ্বীপ্তও। দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা অদম্য চার মেধাবী জীবন জয়ের দুয়ারে এসে থেমে গেলেন। শেষ হয়ে গেল তাদের স্বপ্নযাত্রা।

তাদের প্রাণ প্রদীপ নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধূলিসাৎ হলো চার পরিবারের সুখের মুখ দেখার তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের পাহাড়। চার শিক্ষার্থীকে হারিয়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে ক্যাম্পাসে। সমাবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।

অন্যদিকে, দুঃখের দিন শেষের সিঁড়িতে এসে হঠাৎ তাদের মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না চার পরিবারের কেউ।

ময়মনসিংহের ভালুকায় ২৪ মার্চ গ্যাস পাইপলাইন বিস্ম্ফোরণের আগুনে একে একে নিভে গেল ভবিষ্যতের চারটি ‘তারা’। ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে হাফিজুর রহমান এবং শুক্রবার সকালে দ্বীপ্ত সরকার মারা যান। বুধবার মারা যান শাহীন মিয়া। দুর্ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান তৌহিদুল ইসলাম।

নওগাঁর মান্দা উপজেলার বান্দাইপুর গ্রামের বেলাল হোসেনের দ্বিতীয় ছেলে হাফিজুর রহমান। ছেলের সোনালি ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিনান্ত পরিশ্রম করে লেখাপড়ার ব্যয় বহন করে আসছিলেন তার দিনমজুর বাবা। একদিন বাবার সব দুঃখ-কষ্টের অবসান করতে চেয়েছিলেন হাফিজুর। সব কিছু এখন স্মৃতি হয়ে গেল। ছেলেকে হারিয়ে এখন দিশেহারা বেলাল হোসেন। গ্রামজুড়ে চলছে মাতম। হাফিজুরের মা পারুল আক্তার ছেলের মৃত্যুর খবরে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তার মুখে একটাই প্রশ্ন- ‘কে আমার ছেলের জীবন কেড়ে নিল? কে?’ এখনও তার এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি কেউ। সব কিছু রয়েছে তদন্ত পর্যায়ে। দরিদ্র বাবা-মা হাফিজুরের সব চাহিদা মেটাতে না পারলেও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে তাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। হাফিজুর তা মাকে বলতেন, ‘ও মা, দেখো, চাকরি পেলে আমাদের সব কষ্ট শেষ হয়ে যাবে। টিনের ছাউনি ফেলে ছাদ করে দেব, ছোটকে ডাক্তার বানাবো।’ কিন্তু কষ্ট শেষের স্বপ্ন ভেঙে পড়ল অকালে।

মান্দা উপজেলার পরাণপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও মান্দা মমিন শাহানা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন হাফিজুর। তাকে নিয়ে এলাকার মানুষেরও অনেক গর্ব ছিল। দরিদ্র হয়েও ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর দিয়ে জীবনের বাধা পার হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।

হাফিজুরের মতো দ্বীপ্ত সরকারও কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে পার হয়ে এক পৃথিবী স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দপ করে নিভে গেল দীপ্তর জীবন প্রদীপ। সেই সঙ্গে বিধবা মায়ের সব প্রচেষ্টা ও স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। মাগুরার শালিখা উপজেলার তালঘড়ি ইউনিয়নের দিঘল গ্রামের মেধাবী সন্তান দ্বীপ্ত ভবিষ্যতে বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করতে চেয়েছিলেন।

দীপ্তর আত্মীয় শিক্ষক বিষ্ণুপদ সরকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চার বোন দুই ভায়ের মধ্যে দীপ্ত সবার ছোট। ১২ বছর আগে তাদের বাবা মারা যান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বড় ভাই নারায়ণ সরকার। অনেক কষ্টে ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। স্কুলে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া দীপ্ত এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে পরে কুয়েটে ভর্তি হন। স্কুল, এলাকা ও সহপাঠীদের মধ্যে দীপ্ত ছিল সবার ভালোবাসার। এত আদরের ছেলের মৃত্যু তারা কোনো মতে সইতে পারছেন না। ‘দীপ্ত রে! দ্বীপ্ত রে!’ গগণবিদারী চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তিনি। গ্রামবাসী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুরা চোখের জলে তার স্মৃতি স্মরণ করছে। শুক্রবার রাতেই তার শেষকৃত্য হবে।

কুয়েটের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষবর্ষের চার সহপাঠী তৌহিদুল, শাহীন, হাফিজুর ও দ্বীপ্ত ইন্টার্নশিপ করতে ভালুকার মাস্টারবাড়ি এলাকায় স্কয়ার ইন্ডাস্ট্রিজের একটি কারখানার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সব কিছু তাদের পরিকল্পনামতো চলছিল। ইন্টার্নশিপ শেষে চাকরি হবে, মা-বাবা, ভাই-বোনের মুখে হাসি ফুটবে এবং আরও কত স্বপ্ন ছিল তাদের। কিন্তু ২৪ মার্চে ভাড়া বাসায় গ্যাস পাইপলাইন বিস্ম্ফোরণে জানালা, দরজা ও ছাদ ধসে পড়ে। মুখ থুমবে পড়ে তাদের স্বপ্নযাত্রা। ঘটনাস্থলে মারা যান তৌহিদুল। ছয় দিনের মাথায় চার বন্ধু একই পথের পথিক হলেন।

এদিকে চার শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুতে আজ ৩১ মার্চ থেকে আগামী ২ এপ্রিল পর্যন্ত কুয়েটে তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় সমাবর্তনের সকল আয়োজন সংক্ষিপ্ত ও অনাড়ম্বর করা হবে।

কুয়েটের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইয়াসিন আরাফাত সাংবাদিকদের বলেন, ‘সহপাঠীকে হারিয়ে আমরা বাকরুদ্ধ। তাদের চিকিৎসার জন্য প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার টাকা কুয়েট প্রশাসন দিয়েছে। বাকি টাকা কুয়েট শিক্ষার্থীরা দিয়েছেন।