আসছে বর্ষা মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের “টাকার গাছ” খ্যাত পানের বরজগুলোতে চলছে পরিচর্যা। জেলার ১০ উপজেলার পান চাষিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেকে আবার বরজ সংস্কার কাজেও ব্যস্ত। বাঁশ ও বাঁশের শলা দিয়ে মাচা তৈরি করে খড়-কুটা দিয়ে ছাউনি করে সুপারি গাছের পাতা ও কলা পাতা দিয়ে ঘিরে তৈরি করা হচ্ছে পানের বরজ।
কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের মতে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমিতে পানের বরজ রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জেলার ১০ উপজেলায় ২০ হাজার ৩৬ মেট্রিকটন পান উৎপাদন হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ১শ’ কোটি টাকারও বেশি। পান ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশ থেকে যে পরিমান পান বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে, তার সিংহভাগ যাচ্ছে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে। পান একটি লাভজনক ও অর্থকরী ফসল হওয়ায় বিদেশে রপ্তানীর সুযোগ থাকায় এ থেকে অর্জিত একটি বড় অংশ অর্থনৈতিকভাবে জিডিপিতে যুক্ত হতে পারে বলে মনে করেন বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামারবাড়ির সূত্রে জানা যায়, বরিশাল জেলার ১০ উপজেলায় ২ হাজার ৯২৫ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়। এর মধ্যে বরিশাল সদর উপজেলায় ৪৫ হেক্টর, বাবুগঞ্জ উপজেলায় ১২৫ হেক্টর, উজিরপুর উপজেলায় ৩১৫ হেক্টর, বাকেরগঞ্জ উপজেলায় ৫০০ হেক্টর, গৌরনদী উপজেলায় ১ হাজার ৫০ হেক্টর, আগৈলঝাড়ায় উপজেলায় ২৭৫ হেক্টর, মুলাদি উপজেলায় ১৫০ হেক্টর, হিজলাউপজেলায় ১৬০ হেক্টর, মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় ২০০ হেক্টর, বানারীপাড়া উপজেলায় ১০৫ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়।
খামারবাড়ির সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বরিশাল সদর উপজেলায় ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ৩২৮ মেট্রিকটন, বাবুগঞ্জে ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ৭৮৭ মেট্রিকটন, উজিরপুরে ৮ দশমিক ০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৫২০ মেট্রিকটন, বাকেরগঞ্জে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ৫৫০ মেট্রিকটন, গৌরনদীতে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ৪৫৮ মেট্রিকটন, আগৈলঝাড়ায় ৭ দশমিক ১০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৯৫৩ মেট্রিকটন, মুলাদিতে ৮ দশমিক ০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ২০০ মেট্রিকটন, হিজলায় ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৯৬ মেট্রিকটন, মেহেন্দিগঞ্জে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৪৪০ মেট্রিকটন ও বানারীপাড়া উপজেলায় ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ হেক্টর প্রতি ৭০৪ মেট্রিকটন পান উৎপাদন হয়।
সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের পান এখন মধ্যপ্রাচ্যের বাজার দখল করেছে। দেশ থেকে যে পরিমান রপ্তানী হচ্ছে, তার সিংহভাগই যাচ্ছে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে। তবে অনাদিকাল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় পানের আবাদ হলেও এখনো তা খুব একটা আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা লাভ করেনি। সম্প্রিতিককালে লাভের পরিমান বৃদ্ধি পাওয়ায় সব ধর্ম ও শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে পান চাষের প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। বরিশালের শুধু উজিরপুর ও আগৈলঝাড়া এলাকার গ্রামজুড়ে এখন সহ¯্রাধিক পান বরজ রয়েছে। এসব এলাকার বরজগুলোতে চোখে পড়ে সবুজের সমারহ। লতার সাথে এ যেন “টাকার গাছ” দাড়িয়ে রয়েছে। লাভজনক ফসল হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে ক্রমেই পান বরজের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
জলবায়ুগত কারনে বরিশালের পান বেশ সুস্বাদু হওয়ায় দেশÑবিদেশে এর চাহিদাও যথেষ্ঠ। বিগত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানে বরিশালের পান রপ্তানি হলেও এখন তা মধ্যপ্রাচ্যের বাজারেও ঢুকছে। আর বরিশালের পান সংগ্রহে গৌরনদীর টরকি বন্দরে গড়ে উঠেছ আধুনিক পাইকারী পান বাজার। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা এ মার্কেটটি দুপর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত থাকে কোলাহল মূখর। রপ্তানিকারকগণ এ পাইকারি মাকের্টের মাধ্যমে পান কিনে আকাশপথে বিশেষ ব্যবস্থায় বিদেশে রপ্তানী করছে।
আগৈলঝাড়া উপজেলার পান চাষি রত্তন ঘরামী জানান, অন্যান্য ফসলের চেয়ে পান চাষে তারা বেশী লাভবান হচ্ছেন। বরজে গাছ লাগানোর চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই পান বিক্রির উপযোগী হয়। সপ্তাহে ২-৩ দিন বাজারে বিক্রি করা যায়। প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ বেশী হলেও একটি বরজ করলে একটানা ১৫-২০ বছর পান বিক্রী করে মুনাফা অর্জন করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।
উজিরপুর উপজেলার পান চাষি কামাল মিয়া বলেন, বিভিন্ন ধরণের কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা কমে গেছে। তাই ধান, গম, তিলসহ অন্যান্য ফসল এখন তেমন একটা উৎপাদন হচ্ছে না। তাই পানে চাষে ঝুঁকছেন তিনি। ভালভাবে যতœ করলে পানের উৎপাদনও বেশি হয়। যদিও অতি বর্ষন, ঘূর্ণিঝড় এবং টর্ণেডো ছাড়াও বড় ধরনের বন্যার হাত থেকে পান বরজ রক্ষা কঠিন কাজ। তবে স্বল্প জমিতে পান চাষ করে অধিক লাভবান হওয়া যায় বলে তারা এখন পানকে ‘টাকার গাছ’ হিসাবে উপাধি দিয়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশালের উপপরিচালক হৃদয়েশ্বর দত্ত জানান, সম্প্রতি বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের পক্ষ থেকে বরিশাল সদর ও উজিরপুর উপজেলার পানচাষীদের নিয়ে “নিরাপদ পান উৎপাদন” বিষয়ক একটি কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই কর্মসূচিতে পান চাষে কীটনাশক বা সার স্প্রে না করার জন্য পানচাষীদের বলা হয় এবং নিরাপদ পান উৎপাদনের জন্য তাদেরকে বিভিন্ন পরামর্শের পাশাপাশি উপযুক্ত সার ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে সারাবছরই পানের চাহিদা রয়েছে এবং সঠিক দামও পাচ্ছেন পানচাষিরা। এ কারণে অনেক কৃষকই পান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তাছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের পান বিশে^র বিভিন্ন দেশে রপ্তানীর সুযোগ থাকায় এ থেকে অর্জিত একটি বড় অংশ অর্থনৈতিকভাবে জিডিপিতে যুক্ত হতে পারে বলে মনে করেন বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা।