অগ্রিম শীতের সম্ভাবনা নেই
আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা
জানুয়ারিতে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ
কুয়াশা, শিশিরের সৌন্দর্য্যের ঋতু শীত। এ ঋতুর মূল বৈশিষ্ট্য তাপমাত্রা কমে গিয়ে শীতের আলিঙ্গন। এই আলিঙ্গন কারও জন্য উপভোগের, কারও জন্য দুর্ভোগের। এবার বর্ষার অস্বাভাবিকতার পর গুটি গুটি পায়ে প্রকৃতি ও জনজীবনে স্থান করে নিচ্ছে শীত। এর মধ্যেই অনেকের জিজ্ঞাসা- কেমন হবে এবারের শীত!
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, অক্টোবর মাসে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল। এই প্রেক্ষাপটে অগ্রিম শীত নামার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।
তাপমাত্রা কমার ধারাবাহিকতায় জানুয়ারি মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিতে পারে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। এই সময়ে তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যেতে পারে বলেও জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। পৌষ মাসের শেষার্ধ ও মাঘ মাসের প্রথমার্ধ মিলে হবে জানুয়ারি মাস।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণে দেখেছি যে, অক্টোবরের তাপমাত্রা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। তাই বলা যায়, গত বছরের তুলনায় অক্টোবরটা বেশি গরম ছিল। এবার একটু আগেই শীত নামার সম্ভাবনাটা কম। শীত স্বাভাবিক নিয়মেই আসবে বলে আমরা মনে করছি।’
এখন রাতের ও দিনের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তিন মাসের দীর্ঘমেয়াদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ডিসেম্বর মাসের শেষার্ধে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে একটি মৃদু বা মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। জানুয়ারি মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে একটি মাঝারি বা তীব্র ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। অন্যান্য স্থানে এক থেকে দুটি মৃদু বা মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।’
৪ থেকে ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদৃ শৈত্যপ্রবাহ বলা হয় বলেও জানান সামছুদ্দিন আহমেদ।
কাগজে-কলমে পঞ্চম ঋতু শীত শুরু হয় বাংলা সনের পৌষ মাসে। ঋতু বৈচিত্র্যের নিজস্বতায় শীত থাকে মাঘ পর্যন্ত। কিন্তু এর আগে-পরেও থাকে শীতের আমেজ।
গত মাসের শেষের দিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের মেঘ চলে আসায় প্রায় সারাদেশেই বৃষ্টি হয়, তখন তাপমাত্রা কিছুটা কমে যায়। মেঘ কেটে গেলে আবার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এখন আবার সাগরে লঘুচাপের প্রভাব পড়েছে। মেঘে ঢাকা থাকছে আকাশ, হচ্ছে হালকা বৃষ্টি। তাপমাত্রাও ওঠা-নামা করছে।
গত ২৫ অক্টোবর দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে হয় ১৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওইদিন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় এই তাপমাত্রা ছিল। ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল সোমবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়ায় ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মঙ্গলবার এটা খালিকটা বেড়ে হয়েছে ১৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গতকাল সোমবার ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৪ দশমিক ৫ এবং সর্বোচ্চ ৩২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মঙ্গলবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমে হয়েছে ২২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন বলেন, ‘কার্তিকের এ সময় একটু একটু শীত অনুভূত হয়। দিনের তাপমাত্রা বেশি থাকে, কিন্তু ভোরবেলা বা সন্ধ্যাবেলায় ঠান্ডা অনুভূত হয়। গ্রামে এই অনুভূতি বেশি। এটাকে ঠিক শীত বলা যাবে না, এটা হচ্ছে তাপমাত্রা কমে যাওয়া। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা যে কমছে সেটারই প্রভাব। অন্যান্য সময়েও মোটামুটি এমনটাই থাকে।’
এবার বর্ষাকালে জুলাইয়ের পর বৃষ্টি কম হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির সঙ্গে শীতের কোনো সম্পর্ক নেই। শীত বেশি হবে না কম হবে- সেটাও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না।’
তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে আরিফ হোসেন বলেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু (বর্ষা) দেশ থেকে চলে গেলে উত্তর দিক থেকে একটু একটু করে বাতাস প্রবাহিত হতে শুরু করে। এতে অক্টোবর থেকে তাপমাত্রা কমতে থাকে। শীতের বাতাস হিমালয় পর্বতমালা ও তিব্বত থেকে আসে। একটা বাতাস উত্তর-পূর্ব, আরেকটা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসে। এই বাতাস আমরা অলরেডি পাচ্ছি। বাতাসটা গতি নিয়ে প্রবাহিত হয় মূলত ডিসেম্বর থেকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থান বিষুব রেখার উত্তরে। কিন্তু শীতকালে অবস্থান পরিবর্তন করে সূর্য বিষুব রেখার দক্ষিণে চলে যায়। এখন সূর্যের দক্ষিণায়ন চলছে। ২৩ সেপ্টেম্বরের পর থেকে সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হয়। সূর্য বাংলাদেশ ও হিমালয় অঞ্চলের ওপর থেকে দক্ষিণে সরে গিয়ে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বরাবর থাকবে। এতে আমাদের দেশসহ হিমালয়ের দিকে সূর্যের তাপটা কম পড়বে।’
‘হিমালয় পর্বতমালার কারণে সেখানকার পুরো ঠান্ডা বাতাস আমাদের এখানে আসে না। এটা আসলে আমাদের এখানে বরফ পড়তো। বাধা পেয়ে হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণ দিক দিয়ে অল্প একটু প্রবাহিত হয়’- বলেন আবহাওয়াবিদ আরিফ।
শীতকালে অবস্থান পরিবর্তন করে সূর্য বিষুব রেখার দক্ষিণে চলে যাওয়ায় তখন বাংলাদেশে দিন ছোট হয়। রাত হয় দীর্ঘ। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। সেখান থেকে বরফশীতল বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কখনও কখনও তা তীব্র শীতের শৈত্যপ্রবাহে পরিণত হয়। সাধারণত হাড়কাঁপানো শীতের দেখা মেলে মাঘ মাসে।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও কাছাকাছি শ্রীলঙ্কায় একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়েছে। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে একই এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে।
বৃষ্টিতে অস্বাভাবিকতা
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এবার বর্ষাকালে প্রায় প্রতি মাসেই বৃষ্টির অস্বাভাবিকতা ছিল। গত ৩০ বছরের বৃষ্টিপাতের গড়কে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হিসেবে ধরেন আবহাওয়াবিদরা।
অক্টোবর মাসে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।
এছাড়া আগস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ কম, জুলাই মাসে সারাদেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলেও রংপুর ও সিলেট বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।
তবে গত মে মাসে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং এপ্রিল মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এপ্রিল মাসে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে।
মার্চ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে, তবে ওই সময়ে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
আরও বৃষ্টি হতে পারে
মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলসহ রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের দু-একটি জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
এ সময়ে সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।
মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে ফরিদপুরে, ২২ মিলিমিটার। এছাড়া টাঙ্গাইলে ৫ মিলিমিটার, ঈশ্বরদীতে ৪ মিলিমিটার, ময়মনসিংহে ৭ মিলিমিটার, মাদারীপুরে ১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই সময়ে ঢাকায় সামান্য বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।