ছোটগল্পঃ দু’টি ট্রাক – প্রথম পার্ট

:
: ৪ years ago

মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম:: গভীর রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিউজ ফিডে মধ্যমা আঙুলের অনবরত উঠানামা চলছিল।আর দেশি-বিদেশি ফেসবুকীয় নিউজের উপর অবচেতন ও অর্ধচেতন মনে চোখদুটির অবহেলিত দৃষ্টি পড়ছিলো। অন্যদিকে মস্তিষ্কের নিউরনগুলো জটিল প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল জীবনের জটিল সমীকরণ সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টায়। মাঝে মাঝে ফেসবুকের বার্তাকক্ষে দু’চারজনের বিচরণ আছে কি’না তাও পরখে একটু -আধটু ঢু মারি। পরিচিত কা’রো কোনো আভাস না পেয়ে এবং ইতিবাচক উপস্থিতির অনুপস্থিতির জন্য পূর্বের কার্যক্রমে ফিরে আসি।

করোনা ভাইরাসের মহামারীতে স্বাভাবিক কাজকর্মে কিছুটা অস্বাভাবিকতা আসায় নির্ঘুমে অবচেতন মনে জেগে আছি। যদিও বাসায় কর্তৃত্ববাদী শাসকের অনুশাসন মেনে খাওয়া-দাওয়া, নাওয়া, আহার, আরাম, বিশ্রাম ও শয়ন এজাতীয় দৈনন্দিন জীবনচারণের সূত্রগুগো অক্ষরে অক্ষরে পালনের বাধ্যবাধকতা আছে। তা সত্ত্বেও আমি লুকিয়ে লুকিয়ে অনুশাসনগুলো অহরহ ভেঙে যাচ্ছি কর্তৃত্ববাদী শাসকের বিরুদ্ধে গোপনে গোপনে বিদ্রোহীভাবাপন্ন মনোভাব নিয়ে। শৃঙ্খল ভাঙনের বৈপ্লবিক শক্তি ও সাহসিকতা আমার মধ্যে মোটেও নেই বললেই চলে।

কিন্তু বৃত্ত ভাঙার সহজাত নেশা আমাকে অনবরত তাড়িত করে অহর্ণিশ। যা’ই হোক, বিছানায় শুয়ে শুয়ে মুঠোফোনের আয়তকার ক্ষেত্রের স্ক্রীনে নীরবে নীরবে খুবই সতর্কতার চোখের মূল্যবান দৃষ্টির অপব্যবহার করছি। পাশে তীব্র কাঙ্ক্ষিত ঘুমে আচ্ছন্ন গৃহের কর্তৃত্ববাদী শাসক। যার ঘুমের বিঘ্নতা ঘটলে আমার ভাগ্যে জোটে রূঢ় তিরস্কার ও সশ্রম শাস্তি।

উক্ত সশ্রম শাস্তির পৃষ্ঠচাপ নীরবে মেনে না নিয়ে কোনো উপায় নেই। একটু হাত-পা নড়াচড়া, এপাশ-ওপাশ ফিরে শয়নে পাশের কর্তৃত্ববাদী শাসকের সূক্ষ্ম ও রাজকীয় শয়নে( সুখনিদ্রায়) বিঘ্নতা তৈরি হয়। তাই অতি সতর্কতার সাথে মোবাইলের আয়তবর্গীয় স্ক্রীনে স্ক্রল করি। স্ক্রল করতে করতে নিম্মবর্ণিত বিষয়ে মুক্তবাক আলোচনার সরাসরি অনুষ্ঠানে (লাইভ শো) আমার দৃষ্টি ও মনোযোগ নিক্ষিপ্ত হয়।

“ঈশ্বরের কাছে নত হওয়া আর একজন গ্যাংস্টারের কাছে নত হবার মধ্যে পার্থক্য কী?” – গভীর মনোযোগ দিয়ে আস্তি-নাস্তির অযৌক্তিক-যৌক্তিক কথোপকথনগুলো শুনতেছিলাম।আর পাশে শায়িত কর্তৃত্ববাদী শাসকের দিকে হালকা নজর দিচ্ছিলাম। যাতে করে তার সুখনিদ্রায় কোন ধরনের অনাকাঙ্খিত উপদ্রব এসে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি না করতে পারে। যিনি তার কর্তৃত্বের ছড়ি ঘুরিয়ে দু’জন সদস্যবিশিষ্ট পরিবারে শান্তির ঝটিকা সমুন্নত রাখেন।

তার দৈহিক কম্পন বিছানায় ভূমিকম্পীয় আবেশ তৈরি করে। তার প্রবল ভীতিকর চিৎকারে আমার গভীর নিশির মৌনতা ভঙ্গ হয়। তার আনুশাসনিক ক্ষমতার প্রথা ভেঙে বাঁচার আকুতি নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। মাথা ও শরীরে অভয়ের হাত বুলিয়ে নতুন করে ঘুম পরানোর প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হলাম। কারণ করোনা মহামারীর ফলে হাজারো মৃতদেহর প্রতিচ্ছবির দুঃস্বপ্ন তার সুখনিদ্রার সুখানুভূতি কেড়ে নিয়েছে।কী হয়েছে জানতে চাইলে বলল যে, করোনার মত এই ক্ষুদ্র ভাইরাস মৃত-মিছিলের শোভাযাত্রা নিয়ে দিন দিন অগ্রসর হচ্ছে।এই দৃশ্য তার মনোজাগতিক অবয়বে অস্থিতিশীল আলোড়ন তৈরি করেছে। এ ক্ষুদ্র জীবনে আর কয়টা দিন বেঁচে থাকার বাসনা প্রকাশ করে। বাঁচা-মরার এ লীলাখেলায় নিজের অস্তিত্ব- সঙ্কট ব্যাপকভাবে মস্তিষ্কের নিউরন দিয়ে অনুধাবন করে।আসা যাক ঘুমন্ত কর্তৃত্ববাদী শাসক ঘুমের মধ্যে কোন কোন জাগতিক জগৎ ঘুরে এসেছে তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণে।

তার ভাষ্যমতে, “করোনা মহামারীর সময়ে এই আলো-বাতাসহীন শ্বাসরুদ্ধকর গৃহবন্দী জীবনের বিশাল ভার বহন করতে না পেরে কোনো এক বিকালে বৈকালিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে ঘরের বাইরে বের হবার সিদ্ধান্ত নিলাম। মুক্ত পৃথিবীর স্বাদ আস্বাদনে বের হলাম দু’জনে। গ্রাম-শহরের যৌথ প্রতিবেশের এক নান্দনিক ও অনান্দনিক আবহে হাটছি দু’ জনে একে অপরের হাত ধরে। কাঁচা বাস্তার দু’পাশে দূর্বাঘাসের প্রাকৃতিক বর্ধন একটা নতুনত্বের নকশা তৈরি করেছে। যা সহজ-সরল জীবনের দার্শনিকতার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে বহুকাল ধরে। মাঝখানে দূর্বাঘাসবিহীন মাটির সরু পথটিতে মনুষ্য প্রজাতির পদচারণায় দূর্বাঘাসগুলো আপন মহিমায় নিজ অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে উঠতে পারেনি।

উক্ত পথটিতে একে অপরের হাত ধরাধরি করে চলছি। যা আমাদের মধ্যে এক অসাধারণ রোমাঞ্চ তৈরি করেছে। হাটতে হাটতে এক সময় দূর্বাঘাসগুলোর আতিথিয়েতার কোমল আমন্ত্রণে ও উষ্ণ সম্বোধনে তাদের নিঃস্বার্থ বিছানো সবুজ চাদরের বিছানায় বসে পরলাম। টুকিটাকি গল্প চলছিল তার স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু ঘুরেফিরে জীবন নামক জটিল অঙ্কের সমাধান কষার দ্ব্যর্থক অনুষঙ্গটি আসলো খুবই প্রকটতা নিয়ে। চাকুরি, অর্থ-বিত্ত, বাড়ি-ঘর, সম্মান, সামাজিক মর্যাদা, আত্মীয়-সজনের অবহেলা ও অনাকাঙ্খিত উপদ্রব, বাবা-মা’র ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা ও আমাদের সরলভাবে বাঁচার সরলীকরণের গাণিতিক সূত্র।

মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম

প্রভাষক,

ইংরেজি বিভাগ গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, বরিশাল।