ছেলের লাশের খোঁজে ভোলা থেকে ঢাকা ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

লকডাউনে বাস আর লঞ্চ বন্ধ; বার বার বাহন বদলে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে দক্ষিণের জেলা ভোলা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন ৭০ বছর বয়সী মন্নান মাতব্বর।

এই কঠিন সময়ে এতটা পথ তাকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে ছেলের লাশ শনাক্ত করার জন্য।

দুদিন আগে নারায়ণগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় ভয়াবহ আগ্নিকাণ্ডের পর যে শ্রমিকদের খোঁজ এখনও মেলেনি, মন্নান মাতব্বরের ছেলে নোমান মাতব্বর (২২) তাদের একজন।

রোববার সকালে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে মন্নান মাতব্বরের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল,তার চোখেমুখে তখন পুত্র হারানোর শোক আর দীর্ঘ পথের ক্লান্তি।

হাসেম ফুডস কারখানায় আগুন লাগার খবর তিনি বৃহস্পতিবার রাতেই পেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।

এর মধ্যে শুক্রবার পেলেন অর্ধশত মৃত্যুর খবর, তখনই তিনি যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। কিন্তু ঢাকা আসার উপায় না দেখে তার বুকে কষ্টের ভার কেবল বাড়ছিল।

শেষ পর্যন্ত মেয়ে জামাইকে সঙ্গে নিয়ে শনিবার দুপুরে ভোলার চরফ্যাশনের এওয়াজপুর থেকে রওয়ানা দেন মন্নান।

কয়েকবার বাহন পাল্টে ভেঙে ভেঙে আসতে তার লেগে যায় ১৪ ঘণ্টা। রাত ২টায় ঢাকা পৌঁছে এক আত্মীয়র বাসায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে এসেছেন মর্গে।

নিচুস্বরে তিনি বললেন, প্রথমে মোটরসাইকেলে করে কিছুদূর এগিয়ে পরে একটি মাছের গাড়িতে চেপে এতটা পথ এসেছেন। পথে কয়েকবার পুলিশ আটকালেও ঘটনা শুনে ছেড়ে দিয়েছে।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মন্নান বললেন, “আমার তিন ছেলে তিন মেয়ে ছিল বাবা। একে একে সব ছেলে মারা গেল। এই বৃদ্ধ বয়সে এখন আমার আর কেউ রইল না।”

মন্নানের তিন ছেলের মধ্যে ১৩ বছর বয়সী হারুণ আর তার এক বছরের ছোট রাকিব এক যুগ আগে ডায়রিয়ায় মারা যায়।

নোমান বড় হয়ে কারখানার কাজে যোগ দেন, তিনিই জাগিয়ে রেখেছিলেন বৃদ্ধ বাবার আশা। সে আশাও এখন নিভে গেল।

নোমানের ভগ্নিপতি আলী রতন জানালেন, ভোলা থেকে দুজনের ভেঙে ভেঙে আসতে ছয় হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

তিনি বললেন, “আমরা সচ্ছল নই, সব বোঝা এখন এই বৃদ্ধের উপর।”

কিশোর হাসনাইন কাজ করত নারায়ণগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায়। তার লাশ নিতে ভোলা থেকে ঢাকা মেডিকেলে এসেছেন তার বাবা-মা।কিশোর হাসনাইন কাজ করত নারায়ণগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায়।

তার লাশ নিতে ভোলা থেকে ঢাকা মেডিকেলে এসেছেন তার বাবা-মা।বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাসেম ফুডস কারখানায় আগুন লাগার পর রাতেই তিনজনের মৃত্যুর খবর জানা গিয়েছিল।

শুক্রবার দুপুরে ওই পোড়া ভবন থেকে বের করে আনা হয় আরও ৪৮ জনের মৃতদেহ। সেগুলো এতটাই পুড়ে গেছে যে দেখে আর চেনার উপায় নেই।

ফলে নিহতদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে স্বজনদের সঙ্গে মিলিয়ে পরিচয় শনাক্ত করা ছাড়া আর কোনো উপায় এখন নেই।

ডিএনএ পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বলছে, পরিচয় শনাক্ত করে স্বজনদের হাতে লাশ বুঝিয়ে দিতে সপ্তাহ তিনেক সময় লাগবে তাদের।

ফলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় এসেও ছেলের লাশ বুঝে পাননি বৃদ্ধ মন্নান মাতব্বর। তার ডিএনএ পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা নিয়ে রেখেছে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ।

হাসেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ডের পর জানা গেছে, কারখানাটিতে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ, জরুরি নির্গমন পথও তালাবন্ধ ছিল।

ওই কারখানাটিয় শিশু শ্রমিক ব্যবহারের বিষয়টিও প্রকাশ্যে এনেছে এই অগ্নিকাণ্ড।

তেমনই এক হতভাগ্য কিশোরের নাম হাসনাইন, বয়স ১২ বছর। তার খোঁজে ভোলার চরফ্যাশনের আবদুল্লাহপুর ইউনিয়ন থেকে ঢাকায় এসেছেন বাবা ফজলুর রহমান, সঙ্গে স্ত্রী, মেয়ে ও বোন।

ফজলুর রহমান জানালেন, হাসনাইন এক সময় চরফ্যাশনের আমিরাবাদে কবি মোজাম্মেল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ত।

“লকডাউনে তো দুই বছর ধরে পড়া বন্ধ। এর মধ্যে আমি অসুস্থ। তাই কন্ট্রাকটর মোতালেবের মাধ্যমে ছেলে আমার নারায়ণগঞ্জের ওই কারখানায় সেমাইয়ের কাজ নিছিল গত রোজায়।”

নাকে টিউমার হওয়ায় ফজলুর রহমানের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে। সেজন্য কয়েকবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চিকিৎসাও নিয়েছেন বলে তিনি জানালেন।

বিলাপ করতে করতে হাসনাইনের মা নাজমা বেগম বললেন, “এখন আমি কাকে নিয়ে বাঁচব?”

এই দম্পতির ছেলে হারানোর যন্ত্রণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লাশ না পাওয়ার কষ্ট। ফজলুর রহমান জানলেন, বহু কষ্টে টাকা জোগাড় করে তারা ঢাকা এসেছেন ছেলের লাশ নিতে।

কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে রক্তের নমুনা নিয়ে বলেছে, লাশ পেতে সময় লাগবে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার রোমানা আক্তার জানালেন, ৪২টি মৃতদেহ শনাক্তের জন্য গত তিন দিনে ৬০ জন স্বজনের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন তারা।

হাসেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শনিবার পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে।

কারখানা মালিক মো. আবুল হাসেম ও তার চার ছেলেসহ আটজনকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।