মনিরুল ইসলাম:: আমার বয়সী অনেকের হয়ত মনে আছে আমজাদ হোসেনের সেই গানটা: হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ…৷ বালক বয়সে সেদিন চলন্ত ট্রেনে গোলাপী/ববিতার দুর্দশায় কেঁদেছি। তারপর জীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতে বুড়ো বয়সে বুঝেছি, জীবন তো এরকমই! সবাইকে কোনো না কোনোভাবে কখনো সখনো ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’ হতেই হয়। কারণে অকারণে অন্ধ হয়েই থাকতে হয়, সারাক্ষণ সবকিছুতে চোখ খোলা রাখলে জীবন চলে না। আর ‘বয়স দোষে’ মানুষ একই ঘটনা একেক সময় একেকভবে দেখে বলে যৌবনে যা কাঁদায়, বার্ধক্যে তা হাসায়।
ভুল বললাম? আমার কেন জানি মনে হয় সংসারে চলতে গেলে, জীবনে টিকতে/বড় হতে হলে চোখ-কান যেমন খোলা রাখতে হয়, তেমনি বন্ধও রাখতে হয়। উদাহরণ? প্রেমে অন্ধ না হলে প্রেমাস্পদ মিলে না, শিষ্য অন্ধ না হলে গুরুভজন হয় না, মতবাদ মতামত বিশ্বাসে অন্ধ না হলে দলনেতা খুশি হয় না, স্নেহ-মমতা-সেবায় অন্ধ না হলে বলে ‘নিষ্ঠুর’! ধনীরা অন্ধ হলেই সুখী হয়, দুঃখীরা অন্ধ বলেই বেঁচে থাকতে পারে।
স্বেচ্ছা-অন্ধের দরকারও আছে। বিচারক যেমন দুইচোখ বেঁধে রাখে যেন মায়া-করুণার ছলে তার ন্যায্যতা টলে ঢলে না পড়ে। গ্রীক দেবী ‘তাইচি’ অন্ধ, কারণ তিনি ধন দৈব নিয়তি বন্টন করেন। আর দৃষ্টির দেবী ‘থেইয়া’ হল সোনা রুপা রত্নের মালিক। অর্থাৎ চক্ষু থাকলেই নিরপেক্ষতা বিনষ্ট হয়। ভারসাম্য রক্ষার জন্য মনসাদেবীর বামচোখে বিষ, ডানচোখে মহৌষধ। দুই চোখে সমান বা সমভাবে দেখা যাবে না। ন্যায়বিচারক সর্বশক্তিমান ঈশ্বরও কি তাহলে অন্ধ কানা? নাঊজুবিল্লাহ! এসব চিন্তাই মানা।
তবে কেউ যে আবার সবার প্রতি অন্ধ, তা-ও কিন্তু নয়। একজন আমার প্রতি অন্ধ কিন্তু আরেকজনের প্রতি দিব্যি চক্ষুস্মান। অর্থাৎ জেগে ঘুমানোর মতো–ইচ্ছে হলে দেখে, না হলে দেখে না। এই দেখাদেখি নিয়ে অন্যকে আবার গালিও দেয় মানুষ। কম দেখলে বলে ‘একচোখা’, বেশি দেখলে বলে ‘বারোচোখা’। অমুককে বলে, ‘বেটা স্বার্থান্ধ, ধর্মান্ধ’। কিন্তু তমুক কি জানে সে নিজেও কমবেশি অন্ধ তার স্বার্থে, তার ধর্মে?
মানুষ মাত্রই পক্ষপাতপূর্ণ। পৃথিবীতে এত দেশ গোষ্ঠী ও ধর্মীয় বিভাজনের কারণও একচোখা নিয়ম-নীতি। জগৎ চলে পক্ষপাতিত্বে, কানায় চালায় সংসার। বোকারা তবু খুঁজে নিরপেক্ষতা, সম্প্রীতি, সার্বজনীনতা। চতুরজন সুযোগ মতো চোখ খুলে আর বুজে, আর সেই দুঃখে বিজ্ঞ লালন গায়, ‘এসব দেখি কানার হাটবাজার।’
আমরা দেখি দুইভাবে: দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে, বিবেক দিয়ে। ইচ্ছাকৃতভাবেই, কেন অন্ধ হয়ে যায় মানুষ? আসলেই কি দেখি না? দেখি সবই, শুনি এবং বুঝিও সব–তবে যখন যা দরকার তা-ই কেবল আমলে নিয়ে দেখি, বাকিগুলির দিকে অন্ধ থাকি। এছাড়া অবশ্য উপায়ও নেই–এত মজা হয় সংসারে, এতকিছু আছে রঙের দুনিয়ায়, সব দেখলে শুনলে পাগলই হতে হবে। ধর্ম মর্ম সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি গোষ্ঠীপ্রীতি আমাদেরকে একচোখা করে রাখে। দুইচোখ নিয়ে প্রতিদিন চলাফেরায় অনেক ঝক্কি-ঝামেলা, একচোখা হয়ে চলায় বাড়তি সুবিধা।
কীভাবে তা করে? নির্লিপ্ত উদাসীনতার ভান করে চোখ বুজে রাখে। মানুষ চোখ থাকিতে অন্ধ হয় নানাভাবে: কর্মে ও চিন্তায়, মোহে বা মায়ায়, কামনা কি বাসনায়। আর হয় বিত্ত বৈভব ক্ষমতায়, ক্রোধে ঘৃণায় হিংসায়, গর্বে গৌরবে ও প্রশংসায়। যুক্তিহীন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মানুষ দূরদৃষ্টি হারিয়ে ফেলে। তাই নিপীড়ক কৃতঘ্ন মানুষ দমনে হননে ভাবে সে ঠিকই করছে। শুধু মুখ নয়, চোখ দেখে যায় এসব মানুষ চেনা।
কারণ মুখের মতো চোখও কথা বলে, চোখেরও পর্দা উঠে যায়, চোখেও রঙ লাগে। চোখাচোখি হলে একে অন্যকে দেখে বুঝে নেয়। আবার সুদৃষ্টির জন্য চর্মচক্ষুরও দরকার হয় না। জ্ঞানালোক থাকলে মানুষ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হয়। তবে বয়সের সাথে এই অন্ধত্বের মাত্রা ও ধরন উঠানামা করে। একই ব্যক্তি কৈশোরে আবেগ, যৌবনে যৌনতাড়না, প্রৌঢ়ে সংসারচিন্তা ও বার্ধক্যে মৃত্যুভাবনায় অন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ জীবনভর তাকে ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’ হয়েই চলতে হয়।
লজ্জার কিছু নেই, কোনো একটা কিছুতে অল্পবিস্তর আমরা সবাই অন্ধ। যে বলে আমি অন্ধ নই–আমি বুদ্ধিমান বিবেকবান দিলদরিয়া, সে-ও তার আমিত্বে, অহং-এ অন্ধ। এই অন্ধত্ব চরমে পৌঁছে না গেলেই হল। তখন আবার সামনে মাছি গেলে ধরে, পেছনে হাতি দেয় ছেড়ে। আর চোখবন্ধ করলেই আত্মরক্ষা হবে না, মন মানসিকতা বিবেক স্বচ্ছ না হলে শুধু চোখ ঢেকে কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে?
ভাবছি, নির্দ্বিধায় নিঃসঙ্কোচে দুচোখ ভরে কোনোদিনই কি কিছু দেখা যাবে না? সমাজ সংসার থেকে সরে গিয়ে দূর অজানায় ধ্যানে বসে দুচোখ বন্ধ করলে হয়ত সব দেখা যায়। আর দেখা সম্ভব নির্লোভ নির্ভার নিরাসক্ত হলে। সেই দেখা ক’জন দেখে, ক’জন চায়, ক’জন পারে। জ্ঞানালোকে মানসচক্ষুর সেই দিব্যদৃষ্টি ক’জন পায় সেজন্যই তো কবিগুরু আকুল হয়ে বলেছিলেন: আরো আলো আরো আলো, প্রভু, এই নয়নে ঢালো।
তবু চোখে আলো পড়ে না। আমার মন বলে দুইচোখে দেখো, বুদ্ধি বলে একচোখে দেখো। বুদ্ধির কারসাজিতে মন হেরে যায়। জানি পৃথিবীকে বুঝতে হলে দুচোখই খোলা রাখতে হবে, দিনশেষে দুচোখই একসাথে মুদিত হবে। সুতরাং মনভরে যেন দুইচোখে দেখি, দুচোখে দেখায়ই প্রাপ্তির শান্তি বেশি। কতদিন আর আত্মপ্রবঞ্চনা করে কানামাছি খেলা, সন্ধ্যা যে হয়ে এলো বেলা।
লেখকঃমনিরুল ইসলাম
রাষ্ট্রদূত,
বাংলাদেশ দূতাবাস, কায়রো,মিশর।