‘চাপ মুক্তিতে’ স্বাধীন পুলিশ কমিশনেই সমাধান দেখছে পুলিশ

লেখক:
প্রকাশ: ৩ দিন আগে

দায়িত্ব পালনে আর কোনও রাজনৈতিক প্রভাব চান না এবং বাহিনীর নিরপেক্ষ ও স্বায়ত্তশাসিত কার্যকারিতা নিশ্চিতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে তারা এই দাবি উত্থাপন করেন।

চার দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫ উদ্বোধনের পর এই বৈঠক হয়। অধিবেশনে বাহিনীর পক্ষে অধ্যাপক ইউনূসের কাছে দুই পুলিশ কর্মকর্তা দাবি উত্থাপন করেন। এ ছাড়া পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষ্যে পুলিশের মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কর্মশালা করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেখানে জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্তত পাঁচটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয় বলে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ আল আসাদ বলেছেন, পুলিশ প্রায়শই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে কাজ করতে বাধ্য হয়। গত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়, পুলিশকে এইভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

পুলিশকে রাজনৈতিক ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশন একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে। কমিশন প্রস্তাবটি নিয়ে কাজ করছে। পুলিশ বিশ্বাস করে যে বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন। যদিও জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন এখনও বিষয়টির সমাধান করেনি।

নিরপেক্ষ আইন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ যাতে স্বাধীনভাবে এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্যই একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন প্রয়োজন।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে কথা বলেন ঢাকা জেলার পুলিশ কনস্টেবল সামিয়া স্বর্ণা। তিনি পুলিশ কর্মীদের এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ-ভাতা দাবি করেছেন। দাবিগুলোর বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস আশ্বাস দেন এবং খুব শিগগিরই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বসবেন বলে জানান।

সভায় পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, পুলিশ সপ্তাহের উদ্দেশ্য হলো নীতি-নির্ধারকদের সাথে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংযুক্ত করা, যাতে পুলিশ কার্যক্রম আধুনিকীকরণ করা যায় এবং বাহিনীর মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি উদ্দীপিত করা যায়।

তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশের ওপরে জনগণের ক্ষোভের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, কার্যকর পদক্ষেপের কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি ফেরানো গেছে।

জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধারে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে সবাইকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তিনি। বলেন, ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সমন্বিত প্রচেষ্টা আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।

আইজিপি উত্থাপিত ঝুঁকি ভাতা বাড়ানো, অপ্রয়োজনীয় ক্রয় স্থগিতকরণ এবং মোটরসাইকেলের জন্য ঋণ প্রদানের প্রস্তাবসহ সহায়ক পদক্ষেপের জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানান। আইজিপি বলেন, আমরা ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি মানবিক, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী হতে চাই।

পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় হয়। এরপর রাজারবাগ অডিটোরিয়ামে বিকেল ৫টা পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার আলোকে প্রণীত কর্মপরিকল্পনার উপরে ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই বিকেল ৫টা থেকে আবার পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ(এসবি) কর্তৃক প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা হয়।

ওই কর্মশালাগুলোতে উপস্থিতি একাধিক পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কর্মশালা থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠ কর্মকর্তাদের সব ধরনের চাপ বা হস্তক্ষেপ মোকাবিলা করে আইন অনুসারে কঠোরভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন। তাদের গুজব মোকাবিলা করার এবং সাধারণ মানুষের কাছে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

কর্মশালায় উত্থাপিত একটি প্রেজেন্টেশনে আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হিসেবে পাঁচটি প্রধান বিষয় তুলে ধরা হয়।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনকল্যাণে শৃঙ্খলা, অংশীদারিত্ব ও দায়িত্বশীল পুলিশি ব্যবস্থার বিষয়ে-আইন প্রয়োগের মাধ্যমে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা, পরাজিত শক্তির উসকানি, অপপ্রচার, শৃঙ্খলা রক্ষা ও শান্তি বিনষ্টকারীদের অপচেষ্টা প্রতিরোধ করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে বলা হয় মাঠ পুলিশকে।

ইতিবাচক মনোভাব ও জনবান্ধব আচরণের মাধ্যমে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ‘পুলিশ খারাপ না’ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য অন্ধকার যুগের চিন্তা এবং খারাপ নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে আসার কথা বলা হয়।

তৃতীয়ত দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে পুলিশের ভূমিকা বিষয়ে আলোচনায় বলা হয়, সামনের নির্বাচনে পুলিশ কোনোরকম চাপ, শক্তি বা হস্তক্ষেপের কাছে মাথা নত না করে আইনানুসারে দায়িত্ব পালন করা এবং নির্বাচন এগিয়ে এলে বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার তীব্রতর হওয়ার প্রবণতা তৈরি হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয় এবং এজন্য পুলিশকে ফ্রন্ট ফোর্স হিসেবে এসব বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার শনাক্ত করে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে হবে বলে নির্দেশ প্রদান করা হয়।

কর্মশালায় অবৈধ অস্ত্র ও লুণ্ঠিত অস্ত্র জাতীয় নির্বাচনে নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে বলে চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব, নানা দাবিতে বিক্ষোভ ও সহিংসতা সামাজিক স্থিতিশীলতা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে বলে আলোচনায় উঠে আসে। বন্দী পলায়ন, সন্ত্রাসীদের জামিন, দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে চরমপন্থি প্রভাব এবং রোহিঙ্গা ও আরাকান সংকটে সীমান্তের অস্থিতিশীলতাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়