দেশের উত্তর ও দক্ষিণে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সরকার বলছে, এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে রংপুর, বরিশাল ও খুলনায় শিল্পের বিকাশ হবে।
গ্যাসের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে উত্তরের রংপুরবাসী। অবশেষে তাদের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। রংপুর বিভাগে গ্যাস সরবরাহের জন্য সঞ্চালন ও বিতরণ নেটওয়ার্ক নির্মাণে প্রায় ১৮শ’ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ-সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) জ্বালানি বিভাগে পাঠিয়েছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)।
সুখবর রয়েছে দক্ষিণের বরিশাল ও খুলনার জন্যও। ভোলায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে। এই গ্যাস ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনায় নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার দুটি গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করবে জিটিসিএল। এ ছাড়া দেশের অন্য অঞ্চল থেকে খুলনায় গ্যাস নিতে ৬ হাজার ৪২৭ কোটি টাকার আরও তিনটি পাইপলাইন প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে জিটিসিএল। ভোলার গ্যাস ছাড়াও আমদানি করা এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) পাইপলাইনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে যাবে।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী আর্থটা্ইমস্ ২৪ প্রতিনিধিকে বলেন, সরকারের লক্ষ্য দেশের সব অঞ্চলের সুষম উন্নয়ন। উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত জ্বালানি। তাই উত্তর ও দক্ষিণের জেলাগুলোতে গ্যাস পৌঁছানো জরুরি। ভোলায় পর্যাপ্ত গ্যাস আছে। এর মজুদ আরও বাড়বে। এখান থেকে প্রথমে বরিশাল ও পরে খুলনায় নেওয়া হবে। বগুড়া পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন আছে। রংপুরে শিল্পের বিকাশের জন্য এই
পাইপলাইন সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। দেশি গ্যাসের মজুদ কমছে, তাই এসব অঞ্চলে নতুন পাইপলাইন কতটুকু যৌক্তিক জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, এলএনজি আসছে। এ ছাড়া ভারতের একটি সঞ্চালন লাইন রংপুরের ওপর দিয়ে যাবে। সেখান থেকে গ্যাস মিলবে। ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বরিশাল ও খুলনায় গ্যাস :দ্বীপ জেলা ভোলার ভেদুরিয়ায় জানুয়ারিতে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের আবিস্কৃত হয়েছে। এ ছাড়া এখানকার পুরনো শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের মজুদও বেড়েছে। সব মিলিয়ে ভোলায় প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এই গ্যাস বরিশাল ও খুলনায় নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুটি প্রকল্প প্রণয়ন করেছে জিটিসিএল। একটি হলো ৬৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভোলা থেকে বরিশাল সঞ্চালন লাইন প্রকল্প। ১ হাজার ১০০ কোটি টাকায় ২৮ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন বসবে, যা দিয়ে ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। এই লাইন নির্মাণের সময় ধরা হয়েছে এ বছরের এপ্রিল থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। বরিশাল থেকে খুলনা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ১০৫ কিলোমিটার একটি পাইপলাইন বসবে। এক হাজার ৪৭১ কোটি টাকার এই পাইপলাইন সর্বোচ্চ ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সঞ্চালন করতে পারবে। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় হিসাব করা হয়েছে।
দেশের জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে সরকার এলএনজি আমদানি করছে। এ বছর দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের কথা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা ৪০০ কোটি ঘনফুটে উন্নীত হবে। এলএনজির জন্য সমুদ্রে ভাসমান টার্মিনালের পাশাপাশি স্থলভাগেও টার্মিনাল বসবে। পটুয়াখালীর পায়রাতে এলএনজি টার্মিনাল হওয়ার কথা রয়েছে। এলএনজি থেকে প্রাপ্ত গ্যাস নিতে খুলনা পর্যন্ত তিনটি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করবে জিটিসিএল। একটি হলো পায়রা বন্দর থেকে খুলনা পর্যন্ত। ২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসবে যা ৭৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস পরিবহনে সক্ষম হবে। বাস্তবায়নকাল চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। লাঙ্গলবন্দ থেকে মাওয়া এবং জাজিরা-গোপালগঞ্জ হয়ে খুলনা পর্যন্ত আরেকটি সঞ্চালন লাইন হবে। এতে ব্যয় হবে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ১৭৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই পাইপলাইন দিয়ে ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে। বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তৃতীয় পাইপলাইনটি হবে সাতক্ষীরার ভোমরা থেকে খুলনা পর্যন্ত। ৯শ’ কোটি টাকার প্রকল্পটির মাধ্যমে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ৬০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। গ্যাস নিতে পারবে ৭০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত। বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
রংপুরে গ্যাস যাচ্ছে :বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন রয়েছে। বগুড়া থেকে রংপুর বিভাগে গ্যাস নিতে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে জিটিসিএল। অর্থের উৎস ধরা হয়েছে জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল। সৈয়দপুর পর্যন্ত প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের আওতায় ২৪ ইঞ্চি ব্যাসের ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসবে। এই সঞ্চালন লাইন দিয়ে ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে। বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। রংপুর ও নীলফামারী জেলার বিভিন্ন অংশে এই গ্যাস সরবরাহের জন্য ১৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় মোট ৭৫ কিলোমিটার বিতরণ লাইন বসবে। এর মধ্যে আট ইঞ্চি ব্যাসর ২৪ কিলোমিটা, ১০ ইঞ্চি ব্যাসের ৪ কিলোমিটার, ১২ ইঞ্চি ব্যাসের ২৫ কিলোমিটার এবং ১৬ ইঞ্চ ব্যাসের ৪২ কিলোমিটার লাইন স্থাপন করা হবে। জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের অর্থে এই পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।