প্রয়াত খোদাবক্স সানুর কাছে তিন বছর গান শিখেছেন তাহসান রহমান খান। সানু স্যারের মেয়ে সভ্যতা পিয়ানো বাজানো শিখেছেন তাহসানের কাছে। সভ্যতার কাছে আবার গান শিখছে তাহসানের মেয়ে আইরা। দুই পরিবারের গুরু-শিষ্যকে নিয়ে লিখেছেন ইসমাত মুমু
সাত বছর বয়সে গান শিখতে শিশু একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন তাহসান। গানের শিক্ষক ও সংগীত পরিচালক খোদাবক্স সানুকে প্রথম দিনের ক্লাস থেকেই পেয়েছিলেন। লাল শার্ট আর সবুজ রঙের প্যান্ট পরে মাটিতে বসে ক্লাস করার স্মৃতি এখনো ভোলেননি, ভোলেননি সানু স্যারকেও, ‘গানে আমার প্রথম ফরমাল শিক্ষক তিনিই। খুবই প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। সারাক্ষণ স্যারের মুখে হাসি লেগেই থাকত। ওনার কারণেই আমরা বাচ্চারা গান শেখাটা ভীষণ উপভোগ করতাম। প্রথম সারগাম থেকে শুরু করে গানের সব কিছু তাঁর কাছ থেকেই শেখা। স্যারের পাঠদান পদ্ধতিও ছিল খুবই মজার। সানু স্যারের কারণেই গানের প্রতি প্রথম ভালোবাসা জন্মে। তিন বছর তাঁর কাছে গান শিখেছি। তিনি না থাকলে আমার শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া হতো না।’
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খোদাবক্স সানু ঢাকার শিশু একাডেমিতে গানের ক্লাস নিয়েছেন। ২০১৪ সালের ১৭ অক্টোবর, ক্লাসে গান শেখানোর একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও শেষ রক্ষা হয়নি, সেদিনই চিকিত্সক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
খোদাবক্স সানু-তাহসান গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক এখানেই শেষ নয়। গুরুর ছোট মেয়ে কারিশমা সানু সভ্যতা পিয়ানো শিখেছেন
তাহসানের কাছেই। তাহসানদের ব্যান্ড ‘ব্ল্যাক’ সবে যাত্রা শুরু করেছে। তখন নিয়ম করে প্রায় ডজনখানেক বাচ্চাকে পিয়ানো শেখাতেন তাহসান। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যেই ছিলেন সভ্যতা। সেই স্মৃতি বললেন সভ্যতা, ‘আমি ছিলাম ব্যাচের সবার ছোট। ক্লাস ফোরে পড়তাম তখন। বয়সে বড় অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়েও আমি ভালো বাজাতাম। তাহসান ভাইয়া আমাকে তাই বেশি আদর করতেন। ভাইয়া তখন থাকতেন পরীবাগে। তাঁর বাসাতেই ক্লাস হতো। ভাইয়া যা শিখিয়েছেন তার কিচ্ছু ভুলিনি। যে খাতাটায় তিনি লিখে দিতেন, সেটা এখনো আছে আমার কাছে। আমি এতই ছোট ছিলাম নিজের নোট লিখতেও পারতাম না। ভাইয়াই লিখে দিতেন। বড় হওয়ার পর আমি মিউজিশিয়ানই হলাম। তাহসান ভাই বেসিক যা শিখিয়েছেন সেগুলোই আমার অনেক বেশি কাজে দিয়েছে।’ মজার ব্যাপার হলো, তাহসান শুরুতে জানতেনই না সভ্যতা যে তাঁর সানু স্যারের মেয়ে! সভ্যতার মা-বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্রখ্যাত গায়ক-সুরকার লাকি আখন্দ। ছোটবেলায় একটা খেলনা কিবোর্ড নিয়ে সারা দিন পড়ে থাকতেন সভ্যতা। এটা দেখে লাকি আখন্দই বলেন সভ্যতাকে পিয়ানো শেখাতে। সভ্যতার মা তখন সন্ধিকে (গায়ক-সুরকার খৈয়াম সানু সন্ধি) বললেন, দেখ তো কোথায় পিয়ানো শেখাতে দেওয়া যায়। বোনকে তাহসানের কাছে নিয়ে গেলেন সন্ধি। তবে ক্লাসে সভ্যতাকে প্রতিদিন নিয়ে যেতেন বড় বোন স্বাগতা (অভিনেত্রী জিনাত সানু স্বাগতা)।
তাহসান বলেন, ‘শুরুতেই মনে হয়েছে সভ্যতা বেশ ট্যালেন্টেড। ওকে শেখানো শুরু করার বেশ কিছুদিন পর জানতে পারি ও সানু স্যারের মেয়ে! এটা তখন আমার কাছে বিশেষ একটা পাওয়া মনে হয়েছে। এর পর থেকে ওকে নিজের ছোট বোনের মতো দেখেছি, ওর প্রতি আলাদা একটা স্নেহ তৈরি হয়েছে। আর ও বেশ লক্ষ্মী মেয়েও।’
সভ্যতাও এখন গানের শিক্ষক। এ নিয়ে বেশ গর্বও তাহসানের, ‘ও নিজের ধারায় গান করছে। শুদ্ধ সংগীতের চর্চা করে ও। সব কিছুতে গা ভাসায় না। ও বাবার ফুটস্টেপ ফলো করছে। সানু স্যারের মতো ও বাসায় গান শেখায়। গানের স্কুল করেছে।’
২০০৭ সালে সভ্যতার প্রথম গান প্রকাশ পেল। অর্ণবের সংগীতায়োজনে ‘ঝালমুড়ি’ অ্যালবামে সভ্যতার লেখা ও সুর করা একটা গান প্রকাশ পায়। সেই অ্যালবাম লঞ্চিংয়ে উপস্থিত ছিলেন তাহসানও। সভ্যতা বলেন, ‘সেদিন ভাইয়ার চোখেমুখে একটা তৃপ্তি দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হলো তাঁর শিষ্য হয়ে একটা কিছু অর্জন করতে পেরেছি। তাঁকে খুব গর্বিত মনে হয়েছিল। আমার কোনো স্টুডেন্টের গান বের হলে আমারও খুব খুশি লাগে। তাহসান ভাইয়া অনেক ভালো টিচার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তাঁর কাছে গান শিখেছি। হয়তো পরীক্ষার সময় দুই মাস যাইনি, আবার গেছি। সব সময় গানের ব্যাপারে খুব উত্সাহ দিতেন। আমি ওই বয়সেই গান বানাতাম। নিজে কিছু লিখে সেটা সুর করে তাঁকে শোনাতাম। তিনি কারেকশন করে দিতেন, ধরে ধরে বুঝাতেন যে এটা এভাবে করতে হয়। তাঁর গান শুনে নতুন কোনো সুর করার উত্সাহ পেয়েছি। গান লেখার ব্যাকরণটা কিন্তু আমি তাঁর কাছেই শিখেছি। হয়তো অনেক কিছু তাঁর কাছে শিখিনি, তবে শুরুটা তিনিই শিখিয়েছেন।’
তাহসান ও সভ্যতারা হয়ে ওঠেন পারিবারিক বন্ধু। তাহসানদের বাসায় যাওয়া হতো সভ্যতার। এ বছরে এসে তাহসানের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হলো সভ্যতার। তাহসানের মেয়ে আইরা তাহরিম খানের সংগীত শিক্ষক হলেন সভ্যতা। সভ্যতা বলেন, ‘এই কোয়ারেন্টিনে অনলাইনে গানের ক্লাস নিতে শুরু করলাম। ভাবলাম আমি যেহেতু অনেক বাচ্চার ক্লাস নিচ্ছি, আইরাকেও একটু গান শেখাই। কারণ মিথিলা আপু বা তাহসান ভাইয়ার ফেসবুকে দেখেছি আইরা গান গায়, গান বানানোর চেষ্টা করে। ওরও গানের প্রতি আলাদা একটা টান আছে। মনে হয়েছে, ওকে সময় দিতে পারলে ও রেগুলার চর্চা করতে পারবে। আর আইরা তো এমনিতেও অনেক স্নেহের। লক্ষ্মী ও মেধাবী একটা বাচ্চা। আমি যে টাস্কগুলো দিই সেটা সে নিয়মিত কমপ্লিট করে রাখে।’
মজার ব্যাপার, আইরাও জানে বাবার শিক্ষকের মেয়ের কাছে গানের তালিম নিচ্ছে সে। তাহসান বলেন, ‘আমি যে সানু স্যারের কাছে শিখেছি বা সভ্যতাকে শিখিয়েছি—আইরা সবটাই জানে। ও গল্পটা মজা করে সব জায়গায় বলেও। আশা করছি সভ্যতার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখবে আইরা। আমিও যতটুকু পারি গানের চর্চাটা করানোর চেষ্টা করি। কিন্তু হাতে ধরে গান শেখানোর কাজটা সভ্যতাই করছে। জানি সে খুব ভালো শেখাচ্ছে।’