গাজীপুরের নতুন নগরপিতা জাহাঙ্গীর

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। ৪২৫টির কেন্দ্রের মধ্যে ৪১৬টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রের ফলাফল অনুযায়ী জাহাঙ্গীর আলম নৌকা প্রতীকে ৪ লাখ ১০টি ভোট পেয়েছেন। বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার পেয়েছেন ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬১১ ভোট। অনিয়ম ও ব্যালট লুটপাটের কারণে ৯টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত রয়েছে।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মন্ডল এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

মঙ্গলবার রাতে এক প্রতিক্রিয়ায় আধুনিক গাজীপুর গড়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন জাহাঙ্গীর আলম। কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করেছেন হাসান সরকার।

গতকাল বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, জাল ভোট, কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের অভিযোগের মধ্য দিয়ে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়। আগামী ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার ছয় মাস আগে অনুষ্ঠিত হলো গাজীপুর সিটির ভোট। ভোটার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ লাখ হলেও সারাদেশের মানুষের নজর ছিল এ ভোটে। দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন কেমন হবে, তা এ নির্বাচন থেকে ধারণা পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই। নির্বাচন কমিশনের জন্যও এ নির্বাচন ছিল চ্যালেঞ্জ। তবে দুপুরের পর কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও সামগ্রিকভাবে এ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে মনে করছেন রাজনীতি ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা।

গতকাল দিনভর গাজীপুর সিটিতে ১০ জন সাংবাদিক ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রের অধিকাংশ ঘুরে দেখেন। তাদের তথ্য অনুযায়ী, আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা গাজীপুর সিটির অধিকাংশ কেন্দ্রেই ভোট ছিল শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছিল ভোটারের দীর্ঘ সারি। ছিল ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। নারী ভোটারের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। দিনভর ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি থাকলেও বিএনপি নেতাকর্মীদের খুব একটা দেখা যায়নি। নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো গোলযোগ কিংবা সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি।

বিএনপি ও দলটির মেয়র প্রার্থীর অভিযোগ, অধিকাংশ কেন্দ্রেই অনিয়ম-জালজালিয়াতির ভোট হয়েছে। আগে থেকেই ব্যালটে সিল দেওয়া হয়। গ্রেফতার, হামলা, বাধার কারণে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা ভোট দিতে পারেননি। আওয়ামী লীগ নেতারা ও জাহাঙ্গীর আলম এ অভিযোগ নাকচ করে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। বিএনপি মিথ্যাচার করছে।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোটের অনিয়মের যে ছবি ও ভিডিও ছড়িয়েছে, তার সত্যতা নেই বলে দাবি করেছেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। বিভিন্ন অনিয়ম ও ভোট জালিয়াতির ঘটনায় নয়টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর সিটি ভোটের রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিবউদ্দিন মণ্ডল। স্থগিত ৯ কেন্দ্রে ভোটের সংখ্যা ২৩ হাজার। মেয়র পদে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধান থাকায় মেয়র পদে ওই নয় কেন্দ্রে আর ভোট হবে না।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, ভোটের অনিয়মের অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেনি বিএনপি। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তিনি। এর আগে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, গাজীপুরে দুই শতাধিক কেন্দ্র দখল ও জাল ভোটের মহোৎসব হয়েছে।

দুপুরে স্থানীয় জেলা বিএনপির কার্যালয়ে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, শতাধিক কেন্দ্র থেকে তার পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন বন্ধেরও দাবি জানান তিনি। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ এবং ৬৭টি কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টকে বের করে দেওয়ারও তথ্য দেন।

ভোটের বেসরকারি ফল প্রকাশের এক পর্যায়ে হাসান সরকার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, গাজীপুর সিটির নির্বাচন খুলনাকেও হার মানিয়েছে। কিন্তু মহানগরবাসীকে দেওয়া কথা রাখতে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে ছিলেন। প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রকাশ্যে সিল মারার পরও নির্বাচন বর্জন না করার কারণ এই সরকারের চরিত্র উন্মোচন করা। নতুন প্রজন্ম আওয়ামী লীগের চরিত্র ভালো করে জেনেছে।

সকাল ৯টার দিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম শহরের কানাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে শিশুকন্যা জারাকে নিয়ে ভোট দেন। তিনি বলেন, বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগ মিথ্যাচার। রাতে জয়ের পথে তিনি বলেন, গাজীপুরের মানুষের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। জনগণ যে পবিত্র দায়িত্ব তাকে দিয়েছে তার অমর্যাদা তিনি করবেন না। বিজয় উল্লাস করতে গিয়ে প্রতিপক্ষকে আঘাত না করার অনুরোধ জানান সমর্থকদের প্রতি।

আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গাজীপুরের প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে হারিয়ে ২০১৩ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির এম এ মান্নান। মেয়র পদে এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন গাজীপুরের ১১ লাখের বেশি ভোটার।

সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটের পর স্থানীয় বঙ্গতাজ অডিটরিয়াম থেকে ফল ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে গণনা শেষে ফল নিয়ে পুলিশি পাহারায় প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা সেখানে জড়ো হন। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে একে একে বিভিন্ন কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করা শুরু হয়। সন্ধ্যার পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা অডিটরিয়ামের সামনে জমায়েত হয়ে উল্লাস করেন। এ সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের দেখা যায়নি।

ভোটের দিনও ছিল একই চিত্র। প্রতিটি কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগের কর্মী ও জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থকদের জমায়েত জটলা থাকলেও হাসান সরকারের সমর্থকদের উপস্থিতি একেবারেই ছিল না। ৪২৫ কেন্দ্রের অধিকাংশের সামনে বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পও ছিল না। সকাল ১১টার দিকে রানী বিলাসমণি সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে শতাধিক তরুণকে ধানের শীষ প্রতীকের ব্যাজ পরে মহড়া দিতে দেখা গেছে। সারাদিনে আর এমন দৃশ্য চোখে পড়েনি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল জাহাঙ্গীরকে সমর্থন দিলেও শরিকদের মাঠে দেখা যায়নি। সরকারের শরিক ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) গাজীপুরে মেয়র প্রার্থী দেয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থনে তৎপরতা দেখা যায়নি। বিএনপির শরিক জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদেরও হাসান সরকারের পক্ষে মাঠে নামতে দেখা যায়নি।

ধানের শীষের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে সড়কে কর্মী-সমর্থকরা না থাকলেও বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকরা ছিলেন সরব। ৫৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে ২৫৬ কাউন্সিলর ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ৮৪ নারী কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। বিএনপি-আওয়ামী লীগের মুখোমুখি সংঘাত না হলেও কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের সংঘাতে দিনভরই বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা ছিল।

ভোট গ্রহণ শেষের দেড় ঘণ্টার মাথায় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ঘোষণা করা হয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএমে) নেওয়া ছয় কেন্দ্রের ফল। প্রথম কেন্দ্রের ফলে এগিয়ে থাকেন জাহাঙ্গীর আলম। শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখেন ৩৯ বছর বয়সী এ নেতা। কয়েকটি কেন্দ্রে হাসান সরকার জয়ী হলেও টঙ্গী পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যানকে হারিয়ে অধিকাংশ কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে নৌকা।

দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ছাড়াও গাজীপুরে মেয়র পদে ভোটে লড়েন আরও পাঁচজন। অবশ্য চরমোনাইয়ের পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী প্রিন্সিপাল নাসির উদ্দিন ছাড়া আর কারও তৎপরতা ভোটের দিনে দেখা যায়নি। তার সমর্থকরা ‘হাতপাখা’র ব্যাজ পরে সারাদিন বিভিন্ন কেন্দ্রে সরব ছিলেন। তবে ভোট চলাকালেই সরকারদলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ করেন নাসির উদ্দিন।