গাছের গায়ে আল্পনা

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

ফলজ বা বনজ গাছ। কোনোটি মোটা আবার কোনোটি সরু অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নিষ্প্রাণ গাছে প্রাণ দেওয়ার তীব্র প্রয়াসে গাছের গায়ে আঁকা হয়েছে ভিন্ন সব কারুকাজ। প্রায় নগ্ন গাছগুলোকে যেন নতুন জামা পরানো হয়েছে। প্রতিটি কাণ্ডে নতুনকুঁড়ি-পাতার দেখাও মিলছে। মানুষ বৃক্ষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে আবার বৃক্ষই মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখছে। যেন সৃষ্টির গোপণ রহস্য সহজেই মেলে ধরা হয়েছে চিত্রগুলোতে। বলছিলাম গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বরে গাছের গায়ে রঙ-তুলি খেলার কথা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা পরিষদ চত্বরে প্রায় শতাধিক ছোট-বড়, মোটা-সরু গাছে করা হয়েছে চিত্রকর্ম। উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. শিবলী সাদিকের উদ্যোগে করা চিত্রকর্মগুলো ইতোমধ্যে স্থানীয়দের নজর কেড়েছে। চিত্রকর্মে বলা হচ্ছে হাজারো গল্প। আর এ গল্প মানুষের, প্রকৃতির ও দেশের। চিত্রশিল্পী আহসান হাবীব সাজুর আঁকা রঙ-তুলির খেলা এখন উপজেলার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এমন চিত্রকর্মে বিমোহিত হচ্ছে সাধারণ মানুষও।

চিত্রশিল্পী আহসান হাবীব সাজুকে এ কাজে সহযোগিতা করেন স্থানীয় আরেক চিত্রশিল্পী উপজেলার দড়িসোম গ্রামের আয়নাল হোসেন। প্রকৃতির প্রেমে পড়ে থাকা একজন শিল্পীই কেবল এমন ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে পারেন, তার প্রমাণ সাজুর চিত্রকর্ম।

উপজেলার পরিষদের বাসিন্দা ও সমবায় অফিসে কর্মরত আসাদুজ্জামান এরশাদ বলেন, ‘পুরো উপজেলাকে যেন রঙিন সাজে সাজানো হয়েছে। দেখতে খুব ভালো লাগছে। সারাদিন কাজ করার পর মনে ক্লান্তি থাকলেও গাছের চিত্রকর্মগুলো দেখলে নিমিশেই ভালো হয়ে যায়।’

 

উপজেলার পরিষদের আরেক বাসিন্দা শিক্ষক শাহানাজ আক্তার বলেন, ‘আসলে গাছের গায়ে রঙ-তুলির আঁচড় উপজেলা পরিষদকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। দেখলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।’

উপজেলা সমাজসেবা অফিসে সেবা নিতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তফা মিয়া বলেন, ‘বয়স হয়েছে, তারপরও নানা রঙ-বেরঙের খেলা দেখলে সেই শৈশব-কৈশোরে ফিরে যাই। আমাদের ইউএনও সাহেব স্ব-উদ্যোগে নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে কাজটি করেছেন। খুবই ভালো লাগছে।’

স্থানীয় আর্টের দোকানদার আয়নাল হোসেন জানান, কালীগঞ্জে তার একটি আর্টের দোকান রয়েছে। নানা ধরনের সাইনবোর্ড বা দেয়াল লেখার কাজ করেন তিনি। কিন্তু এ কাজটিতে সহযোগিতা করে তিনি খুবই মজা পেয়েছেন। কারণ এই ধরনের কাজ এর আগে তিনি কখনো করেননি। গাছের গায়ে চিত্রকর্ম করার পর খুবই ভালো লাগছে। তবে কাজের বা রোজগারের জন্য নয়, এ কাজ করে তার মনে হয়েছে প্রকৃতির জন্য কিছু করেছেন।

 

কথা হয় চিত্রশিল্পী আহসান হাবীব সাজুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতির সঙ্গে গাছ আর মানুষের যে সম্পর্ক, তা তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, বাঁচবে পাখি ও জীবন। সৃষ্টির প্রতিটি জীবন একে-অপরের সঙ্গে জড়িত।’

শিল্পী বলেন, ‘মানুষ যেমন একসময় বৃদ্ধ বয়সে এসে শেষ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি গাছগুলোও তাই। সে রেখে যায় তার বংশধর বা নিদর্শন। মানুষও তাই। গাছের অনেক দুঃখ আছে। যেগুলো প্রকাশ করতে পারে না। রঙ-তুলির আঁচড়ে গাছের গায়ে কষ্টগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। মানুষেরও সেই রকম অনেক কষ্ট থাকে, অনেক কিছু সে প্রকাশ করতে পারে না।’

সাজু আরও বলেন, ‘আমরা সভ্যতার চরম শিখরে আরোহন করেছি, কিন্তু শিক্ষার সেই বিবেককে এখনো জাগ্রত করতে পারি নাই। প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি গাছ আর পরিবেশ। গাছ ধ্বংসের ফলে পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আমি গাছের গায়ে রঙ দিয়ে গাছেরও জীবন-যৌবন আছে সেটা মনে করিয়ে দিয়েছি। আদি যুগে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হতো, ঠিক সেইভাবে গাছকেও আজকাল হত্যা করা হচ্ছে।’

 

‘আমার শৈশব-বেড়ে ওঠা দিনাজপুরের পার্ব্যতীপুর উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে। বর্তমানে কালীগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসে কাজ করি। আমার গ্রামের আশপাশে অনেক বড় বড় গাছ আছে। যেগুলো দিনাজপুর যাওয়ার পথে চোখে পড়ে। ছোটকাল থেকেই সেই বিশাল বিশাল গাছগুলো আমাকে মুগ্ধ করতো। সেই গাছগুলোকে মাঝে মাঝে জড়িয়ে ধরতাম। সেই অন্যরকম ভালো লাগার কাজ করতো আমার মনের ভেতর। এখনো যখন আমি সময় পাই, সেই গাছের সান্নিধ্যে চলে যাই। খুঁজে বেড়াই প্রকৃতির কষ্টগুলোকে’, বলেন তরুণ এই চিত্রশিল্পী।

গাছের গায়ে রঙ করার কারণ খুঁজতে কথা হয় এই কাজের উদ্যোক্তা কালীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. শিবলী সাদিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রংধনু সবারই ভালো লাগে। আকাশে কালো মেঘের পর রংধনুর উদয় হয়। একটু আগে যে আকাশের কালো মেঘে মানুষের মন খারাপ হয়, কিছুক্ষণ পর সেই আকাশের রংধনুতেই মানুষের মন ভালো হয়ে যায়। তাই আমরা চেষ্টা করেছি চিত্রশিল্পীর মাধ্যমে তার চিত্রকর্মে সাত রঙের ব্যবহার করতে। পৃথিবীতে যত কিছুই হোক আমার বিশ্বাস বাহারি রঙের খেলায় সবার মনই রঙিন হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সারাদিন উপজেলায় বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্থানীয়দের সেবা প্রদান কাজে অনেক ব্যস্ত থাকেন। তাই সারাদিনের কাজের ব্যস্ততা শেষে বাড়ি বা বাসায় ফেরার পথে উপজেলা পরিষদ চত্বরে রঙিন চিত্রকর্মের গাছগুলো দেখে সহজেই মন ভালো হয়ে যাবে। আবার অনেক সেবা প্রত্যাশীদের মন খারাপ থাকলে পরিষদ চত্বরের গাছগুলো দেখে তাদেরও মন ভালো হয়ে যাবে।’