গভীর রাতে ডিসি অফিসে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে সাংবাদিককে কারাদণ্ড

:
: ৪ years ago

মধ্যরাতে চলল অভিযান। ঐ অভিযানে বসতঘরের দরজা ভেঙে প্রথমে মারধর, তারপর টেনে-হিঁচড়ে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো এক সাংবাদিককে। এরপর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রাত আড়াইটায় মোবাইল কোর্ট বসিয়ে দেওয়া হলো এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। দণ্ডিত ঐ সাংবাদিক হলেন আরিফুল ইসলাম রিগ্যান। তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংল ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি।

শুক্রবার মধ্যরাতে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে এ ঘটনা ঘটে। তবে ঐ অভিযানে আর কাউকে আটক করে দণ্ড দেওয়া হয়নি। জেলা প্রশাসন দাবি করেছে, ঐ সাংবাদিকের বাড়ি থেকে আধা বোতল (৪৫০ এমএল) দেশি মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা পাওয়ায় এ দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার নিতুসহ পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে অনিয়মের সংবাদ পরিবেশন এবং ফেসবুকে দুর্নীতি সংক্রান্ত পোস্ট দেওয়ার কারণে উনি ক্ষুব্ধ হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। এই অভিযোগ অস্বীকার করে ডিসি সুলতানা পারভীন বিবিসিকে বলেছেন, ‘যদি ঐ ঘটনাই হতো, সেটা তো এক বছর আগের কথা। ঐটা যদি কোনো বিষয় হতো, তাহলে তো তখনই আমরা কোনো অ্যাকশনে যেতাম।’ তিনি বলেন, টাস্কফোর্সের নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক দুলাল বোস বলেন, ‘আরিফুল মদ-গাঁজা তো দূরের কথা, কোনো দিন সে একটি সিগারেটও স্পর্শ করেনি।’

এদিকে গভীর রাতে সাংবাদিকের বাসায় টাস্কফোর্সের অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। দেশ জুড়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয় ঘটনাটি। বিষয়টি খতিয়ে দেখছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) মো. মাসুদ রানার নেতৃত্বে এক সদস্যের কমিটি তদন্তকাজ শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে সাংবাদিক রিগ্যানের স্ত্রী, শ্বশুর মোহাম্মদ আলী, মামা নজরুল ইসলাম ও নূর ইসলাম নুরু, ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, আরিফের ওপর যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই জেলা প্রশাসককে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বিভাগীয় কমিশনারকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।

 

অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাসা থেকে জোর করে তুলে নিয়ে মোবাইল কোর্ট সাজা দিতে পারে না। গাঁজা-মদ যদি ঘরে থেকেও থাকে, তবে তা নজরদারিতে রাখবে। এরপর যখন সময় হবে তখন তাকে মাদকসহ আটক করবে। আর এসব মাদকদ্রব্য যদি কেউ লুকিয়ে রাখে, তাহলে আমাদের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তার নিজস্ব আইনবলে পদক্ষেপ নেবে।’

ঢাকা ল রিপোর্টসের সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান ইত্তেফাককে বলেন, এটা আইন পরিপন্থি কাজ হয়েছে। মোবাইল কোর্ট আইনে কাউকে সরাসরি ধরে অন দ্য স্পটে (ঘটনাস্থল) সাজা দিতে হয়। যদি সেটা ঐ আইনের তপশিলভুক্ত অপরাধ হয়ে থাকে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক তার ক্ষমতার পরিধির বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন কি না এবং যদি করে থাকেন, তাহলে প্রশাসনিকভাবে এটার তদন্ত হওয়া দরকার। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে ঐ সাংবাদিক কারো বিরাগভাজন হয়েছেন, বিশেষ করে ঐ জেলা প্রশাসকের।

অভিযান কার

মাদকবিরোধী অভিযানের উদ্যোগ জেলা প্রশাসন না মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয় নিয়েছিল, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। মোবাইল কোর্ট এভাবে অভিযান চালাতে পারে কি না, জানতে চাওয়া হলে ডিসি সুলতানা পারভীন বিবিসিকে বলেন, ‘টাস্কফোর্সের টোটাল টিম বলতে পারবে, আসলে ব্যাপারটা কী? আমি তো ঘটনাস্থলে ছিলাম না। তবে আমার মনে হয় নিয়মিত মামলা হলে ভালো হতো।’

অভিযান পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ, আনসার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবু জাফর বলেছেন, তিনি এলাকায় ছিলেন না। শনিবার দুপুরে কার্যালয়ের পরিদর্শক জাহিদ তাকে জানিয়েছেন, রাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের অভিযানের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়।

তুই অনেক জ্বালাচ্ছিস’ বলেই মারধর শুরু করে

আরিফুলের স্ত্রী নিতু বলেন, ‘রাত সাড়ে ১২টার দিকে হঠাত্ করে আমাদের বাড়ির গেটে ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুরু হয়। আমরা জানতে চাই কারা ধাক্কাচ্ছে। এ সময় বলা হয়, দরজা খুলুন, না হয় ভেঙে ফেলা হবে। পরে তারা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই মারতে শুরু করে আরিফকে। কেন মারছেন জিজ্ঞাসা করতেই তারা আরিফকে বলে, ‘তুই অনেক জ্বালাচ্ছিস।’ মারতে মারতে তাকে নিয়ে যায়।”

বিক্ষোভ ও মানববন্ধন

আরিফকে সাজা দেওয়ার প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল বিকেলে কুড়িগ্রাম শহরের শাপলা চত্বর এলাকায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে অংশ নেন সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আরিফের মামা কুড়িগ্রাম পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, কারো প্ররোচনায় আরিফকে আটক করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে কোনো সাক্ষ্য না নিয়ে অবৈধভাবে এই সাজা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। বিএফইউজের সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ডিইউজের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু এক যৌথ বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। নেতৃবৃন্দ বলেন, এসব ঘটনার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে সাংবাদিক সমাজের দ্বন্দ্ব তৈরি করার অপচেষ্টা করছে সংশ্লিষ্ট মহলগুলো।

জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করতে চেয়েছিলেন। আরিফুল এ বিষয়ে নিউজ করার পর থেকেই তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ডিসি। সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়োগ বিষয়ে ডিসির অনিয়ম নিয়েও প্রতিবেদন তৈরি করেন আরিফুল। এ সময় একাধিকবার তাকে ডিসি অফিসে ডেকে নিয়ে হুমকি দেওয়া হয়।