খালেদা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করেছিল, কিন্তু ভোটার যায়নি: প্রধানমন্ত্রী

লেখক:
প্রকাশ: ৬ মাস আগে

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি যতবার নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল, তাতে দেশের মানুষ সাড়া দেয়নি। এখন কারও ভোট চুরি করলে সে ধরে নেয়। দৃষ্টান্ত হচ্ছে ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করেছিল। সেখানে সারা দেশে সমস্ত প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, সশস্ত্র বাহিনী— সবাইকে নামিয়ে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। কিন্তু সেখানে ভোটার যায়নি। তারপরেও সিল মেরে বাক্সে ভরে ভোট নিলেও ২২ পার্সেন্টের বেশি হয়নি। এত কষ্ট করার পরও ২১ পার্সেন্ট ভোট হয়েছিল মাত্র। জনগণ কিন্তু মেনে নেয়নি, তারা যে ভোট চুরি করেছে। যে কারণে আন্দোলন হয়, ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হয়। ভোট চুরির অপরাধে নাকে খত দিয়ে খালেদা জিয়ার বিদায় হয়।

 

রোববার (১৪ জানুয়ারি) দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের দ্বিতীয় দিনে নিজ নির্বাচনি এলাকা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে আয়োজিত শুভেচ্ছা ও মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, তারা এখন আন্দোলন করে গণতন্ত্রের জন্য, যারা গণতন্ত্রের ‘গ’-ও বোঝে না। তাদের আন্দোলন মানুষ পুড়িয়ে মারা, গণতন্ত্রের ‘গ’ কেন গণতন্ত্র বানানও করতে পারবে না। তারা জানে জ্বালাও-পোড়াও। জীবন্ত মানুষকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারা, বাসে আগুন, গাড়িতে আগুন, লঞ্চে আগুন, রেলে আগুন। এর আগে ২০১৩ সালে করেছে, ১৪ ও ১৫ তেও এসব করেছে। এখন আবার এই নির্বাচন ঠেকাতেও আন্দোলন করতে গিয়ে ট্রেনে আগুন দিয়ে এমনভাবে পুড়িয়েছে, মা সন্তানকে বুকে নিয়ে পুড়ে কয়লা হয় গেছে। এই দৃশ্য কোনও মানুষ সহ্য করতে পারে না। যে কারণে তারা যতই চিৎকার-চেঁচামেচি করুক, তাদের কথায় জনগণ সারা দেয়নি। যারা এ ধরনের জঘন্য কাজ করেছে, তাদের কোনও ছাড় নেই। তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, নেব।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ, সবার হাতে মোবাইল ফোন, সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা আছে। ঠিক যারা এ কাজগুলো করছে তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা হবে। ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা হুকুমদাতা, যারা জ্বালাও-পোড়াও করার হুকুম দিয়েছে, তাদেরও আমরা গ্রেপ্তার করেছি। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে আর যেন ভবিষ্যতে এভাবে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করতে না পারে, এই ধরনের জঘন্য কাজ করতে না পারে— সেটাই আমরা চাই। আমাদের সামনে অনেক কাজ। আমরা যে উন্নয়ন করে আজকে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছি।

 

 

সরকারপ্রধান বলেন, আপনারা জানেন ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত কখনো শেষ হয় না। এই ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শক্ত একটা ঘাঁটি আছে বলেই আমি যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে পারি। সেই শক্তি আপনারা দিয়েছেন। টুঙ্গিপাড়া-কোটালীপাড়ার মানুষ আমার বড় শক্তি, বাংলাদেশের মানুষ আমার বড় শক্তি। আগামীতেও বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। আমাদের কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষ— এমনকি যারা একেবারেই অনগ্রসর গোষ্ঠী, প্রত্যেকের জন্য কাজ করেছি। প্রত্যেকটি জীবন যেন অর্থবহ হয়, উন্নয়ন হয়, সমৃদ্ধিশালী হয়— সেই কাজটাই আমরা করেছি।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমি এসেছি শুধু আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আপনার আমাকে ভোট দিয়েছেন। কোটলীপাড়াবাসী ও টুঙ্গিপাড়াবাসী আমার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে আপনারাই আমার নির্বাচন করেছেন। আর আপনাদের ভোটেই জয়ী হয়ে আজকে আমি বাংলাদেশের জনগণের সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। তাই আপনাদের প্রতি, কোটালীপাড়াবাসীর প্রতি, যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আপনাদের দোয়া ও আশীর্বাদ চাই। আপনাদের জন্য আমার ভালবাসা রইল। আজ আপনাদের আশ্রয়েই বারবার নির্বাচিত হয়েছি।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এই দেশ, সেই দেশ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাটা জীবন কষ্ট করে সংগ্রাম করে এবং তার ডাকে সারা দিয়ে এই বাংলাদেশের জনগণ অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় এনে স্বাধীন করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তার জীবনটাকেই উৎসর্গ করেছিলেন বাংলার দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। আর এই কাজ করতে গিয়ে তিনি জীবনটাও দিয়ে গেছেন। জীবন দিয়েছিলেন আমার মা, আমার ভাই।

 

শেখ হাসিনা বলেন, রেহানা ও আমি জার্মানিতে ছিলাম। মাত্র ১৫ দিন আগেই দেশ ছেড়ে যাই। তারপরই অমানিশার অন্ধকার আমাদের জীবনে নেমে আসে। ১৫ আগস্ট ৭৫ সাল, একদিন শুনলাম মা-বাবা-ভাই কেউ নেই, দেশেও আসতে পারিনি। এমনকি, জিয়াউর রহমান পাসপোর্টটিও দেয়নি। পাসপোর্টের সময় শেষ হয়ে গেছে আর পাইনি। বিদেশের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে আমরা রিফিউজি হিসাবেই ছিলাম। ৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করে। আমার ছেলে-মেয়ে রেখে আমি আসি আপনাদের মাঝে। আপনারাই আমার সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। যে কারণে আমি বার বার জয়ী হতে পেরেছি, বার বার মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।

 

উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের একটাই লক্ষ্য, জাতির পিতা যে স্বপ্ন দেখেছেন, দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, এদেশের মানুষের অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা করে যাওয়া। আর সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে চাই। আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ এজন্য, অন্য এমপিরা যার যার নিজের এলাকা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমার বাংলাদেশের ৩০০টি আসনের দায়িত্ব, সারাদেশের উন্নয়নের দায়িত্ব। যে কারণে আমি সেভাবে নির্বাচন আপনাদের কাছে এসে করতে পারি না। আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই এ কারণে যে, আমার সকল দায়-দায়িত্ব আপনারই নিয়ে নিয়েছেন। আপনারই তো আমাকে হারানো মা, বাবা, ভাইয়ের স্নেহ দিয়েছেন, ভালবাসা দিয়েছেন। যার ফলে আমি নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে পারছি।

চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের কথা মনে করে শেখ হাসিনা বলেন, আপনার জানেন গত নির্বাচনে অনেক বাধা-বিপত্তি ছিল, অনেক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ছিল, কোনভাবেই যেন নির্বাচন না হয়, না হতে পারে। এটাই ছিল আসল চক্রান্ত। অথচ একটি গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া, কোনও রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় না থাকলে কোনও দেশের উন্নতি হয় না। এটা আমাদের দেশের জন্য প্রমাণিত সত্য। ৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির পিতা ছিলেন, সেই ৭২ সাল থেকে ৩ বছর ৭ মাস ৩ দিন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে গড়ে রেখে যান স্বল্পোন্নত দেশে। কিন্তু এরপর যারা ক্ষমতায় এসেছিল প্রথমে ২১ বছর, এরপর প্রায় ৮ বছর তুলনা করে দেখেন বাংলাদেশের কোনও উন্নতি হয়নি। উন্নতি তখনই হয়েছে কেবল যখনই আওয়ামী লীগ সরকারে এসেছে। ৯৬ সালে প্রথম সরকার গঠন করি, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করি, স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি করি, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করি, রাস্তাঘাট ব্রিজ ব্যাপকভাবে করি।

 

তিনি বলেন, এরপর ২০০১ এ ক্ষমতায় আসতে পারিনি। সেটাও একটা চক্রান্ত ছিল। ইমারজেন্সি হয়, বিএনপির দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, মানি লন্ডারিং, গ্রেনেড হামলা, বোমা হামলা, নানা কারণেই জনগণ বিরক্ত হয়ে পড়ে। যার কারণে ইমারজেন্সি আসে। তাদের দুঃশাসনের কারণে, সেই জঙ্গিবাদ, বাংলাভাই সৃষ্টি করে মানুষের জীবনের শান্তি কেড়ে নিয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচন, সেই নির্বাচনে আ.লীগ নির্বাচিত হয়। এককভাবে আওয়ামী লীগ ২৩৩টি সিট পেয়েছিল। বিএনপি পেয়েছিল মাত্র ৩০টি। তারপর থেকে তারা ইলেকশনে আসতে চায় না। ইলেকশন বানচাল করতে চায়।

ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ধন্যবাদ জানাই আপনাদের, তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র আপনারা ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। নির্বাচন পরিচালনার জন্য যেভাবে আপনারা কমিটি করেছেন, মানুষের কাছে গিয়েছেন, ভোটারদের কাছে গেছেন, অনুরোধ করেছেন, ভোটাররাও ছুটে এসেছেন। ভোটারদের কাছেও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলবো, এত সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করে আপনাদের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি, পৌঁছে দিয়েছি।

বিগত নির্বাচন নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে ’৭৫-এর পরে যেকটি নির্বাচন হয়েছে, সেখানে জনগণের ভোট ছিল না। মিলিটারি এসেছে, জনগণের ভোট নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। কিন্তু আ.লীগ আসার পরই জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছে। সেই সাথে সাথে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা থেকে শুরু করে উন্নয়ন, বিশেষ করে গ্রামের মানুষ যাতে ভালভাবে বাঁচতে পারে, চলতে পারে, জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারে। আমাদের তরুণ সমাজ, তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা ভাইরাসের কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। আবার হামলা শুরু হয়েছে। এজন্য সামনে আরও দুর্দিন আসতে পারে। আমাদের দেশের মাঠি উর্বর। আমাদের মানুষ আছে। এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে। সাথে সাথে হাস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করতে হবে। আমাদের খাদ্য আমাদের উৎপাদন করতে হবে।

 

এর আগে, দুপুরে সড়ক পথে টুঙ্গিপাড়া থেকে কোটালীপাড়া পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে কোটালীপাড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে আয়োজিত শুভেচ্ছা ও মতবিনিময় সভায় যোগ দেন। এর আগে, সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ বাসভবনে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। পরে তিনি রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি শেষ করে ঢাকার উদ্দেশে কোটালীপাড়া ত্যাগ করেন।

দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের প্রথম দিন শনিবার সকাল ৯টায় গণভবন থেকে সড়ক পথে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেলা সাড়ে ১১টায় টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছান শেখ হাসিনা। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে গভীর শ্রদ্ধা জানান। পরে বোন শেখ রেহানাকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের শহিদ সদস্য এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী শহিদের আত্মার শান্তি কামনা করে ফাতেহা পাঠ ও বিশেষ মোনাজাতে অংশ নেন। পরে দলীয় প্রধান হিসেবে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানান। পরে দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ বাসভবনে নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে অংশ নেন।