কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস-লাঠিপেটা, আহত ১৫

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ স্লোগান দিয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে রোববার সারাদেশে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থী-চাকরিপ্রার্থীরা।

এতে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীতে পদযাত্রা করে শাহবাগ অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা।

দাবি পূরণের আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত অবরোধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিলেও রাত ৮টার দিকে পুলিশের জলকামান ও টিয়ার গ্যাসের শেলে আন্দোলনকারীরা পিছু হটে চারুকলার সামনে অবস্থান নেন।

সড়কের ওপর আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন তারা। পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় পুলিশের লাঠিপেটায় চার সাংবাদিকসহ কয়কজন শিক্ষার্থী আহত হন।

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় ও এর আশপাশ এলাকায় অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীদের একের পর এক কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। রোববার রাত সোয়া ১০টা পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশকে মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। সঙ্গে ছিল পুলিশের জলকামান ও লাঠিপেটা।

জবাবে আন্দোলনকারীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে দেখা যায়। এ ঘটনায় রাত ১১টার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৫ আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন। তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

আহতরা হলেন আকরাম হোসেন (২৬), আবুবকর সিদ্দিক (২২), মো. রফিক (২৪), রাফি আলামিন (২২), রাজ (২৩), সোহেল (২৫), ওমর ফারুক (২৫), খোরশেদ (২৬), মাহিম (২২), আসলাম (২৩) ও আওলাদ হোসেন (৫০), শাহ পরাণ (২২), অমিত (২৩) রবিন (২২) ও রাসেল (২২)।

ধাওয়ার মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় রাজু ভাস্কর্যের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাহের হোসেন, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সাইফ হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল আন্দোলনকারীদের মারধর করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এর আগে আন্দোলনকারীদের টানা পাঁচ ঘণ্টার অবরোধে শাহবাগে যান চলাচল বন্ধ থাকে। এতে যানজট ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের সড়কে। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে রাজধানীজুড়ে তীব্র যানজটে ভোগান্তিতে পড়েন কাজ শেষে ঘরমুখো মানুষ।

সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ কোটা প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত। বাকি ৪৪ ভাগে মেধায় নিয়োগ দেওয়া হয়। চাকরিপ্রার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে গত কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছেন।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ আন্দোলন আবারও জোরদার হয়েছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, ১০ শতাংশের বেশি কোটায় নিয়োগ দেওয়া যাবে না। আন্দোলনের মুখে গত মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে।

গত মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, চাকরিতে কোটা শিথিল করা হয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে তাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য কোটা থাকবে।

কোটা শিথিল হলেও আন্দোলনকারীরা বলছেন, তাদের দাবি পূরণ হয়নি। কোটা ব্যবস্থার প্রকৃত সংস্কার হয়নি। তাই পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী রোববার দুপুর ২টার দিকে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জমায়েত হন।

বঙ্গবন্ধুর পোস্টার হাতে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী ‘পদযাত্রা’ করে রাজু ভাস্কর্য দিয়ে নীলক্ষেত, কাঁটাবন ঘুরে বিকেল ৩টার দিকে শাহবাগে অবস্থান নেন।

আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসান আল মামুন  বলেন, তাদের কর্মসূচি অসহিংস, শান্তিপূর্ণ। সড়ক অবরোধ করা হলেও অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি সেবার গাড়ি চলাচলে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। আন্দোলনকারীরা মার খেতে রাজি; কিন্তু কাউকে আঘাত করবে না। সংসদের অধিবেশন থেকে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। চাকরিতে কতভাগ কোটা রাখা যাবে তা নির্ধারণে কমিশন গঠনের দাবি তুলেছেন তারা।

কর্মসূচি চলার সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক খানের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন আন্দোলনকারীরা।

ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. উজ্জ্বল বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কোটায় শূন্য থাকা পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে; কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, কোটার শূন্য আসন অন্য কোটা দিয়ে পূরণ করা হবে।

আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিতে কয়েক দফা চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু অবরোধকারীরা সরে যাননি। রাত ৮টার দিকে পুলিশ আন্দোলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল ছোড়ে। জলকামান এবং উচ্চশব্দের সাইরেনে শিক্ষার্থীরা পিছু হটে। ছত্রভঙ্গ আন্দোলনকারীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে পুলিশ।

আন্দোলনকারী ছাড়াও লাঠিপেটার শিকার হন প্রথম আলোর আসিফুর রহমান, বাসসের কামরুজ্জামান রেজা, বাংলা ট্রিবিউনের হালিম রেজা শোভন ও ইউএনবির ইমরান হোসেন।

আসিফুর রহমান বলেন, তারা পেশাগত দায়িত্ব পালনে শাহবাগ ফুলের মার্কেটের সামনে ছিলেন। আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়ে তাদের পেছন থেকে লাঠিপেটা করে পুলিশ। এ সময় সাংবাদিকদেরও লাঠিপেটা করা হয়। পরে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে সাংবাদিকরা রক্ষা পান।

রাজধানী ছাড়াও সব জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পদযাত্রা ও বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। পদযাত্রা শেষে চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহরে বিক্ষোভ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চুয়েট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নিয়ে দুই ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা। এতে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। সিলেটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে পদযাত্রা করেন শিক্ষার্থীরা।

ময়মনসিংহের বাইপাস এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ সময় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রকিবুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেন।

আন্দোলনকারীদের দাবি, ১০ ভাগের বেশি কোটায় নিয়োগ নয়, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পেলে মেধা তালিকা থেকে নিয়োগ, কোটার বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা নয়, চাকরিতে প্রবেশে অভিন্ন বয়সসীমা, এক পরিবারে কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার নয়। এ পাঁচ দাবিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা আন্দোলন করছেন।