• ঈদের আগে জামিন পান কোটা আন্দোলনের আট নেতা
• পাঁচ মামলার চারটিতেই নেতারা এজাহারভুক্ত আসামি নন
• জামিন পেলেও আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের
• অপরাধে নেতাদের সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ
• ছাত্রলীগের হামলায় আহতদের গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ
• ক্যাম্পাসে ফিরতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা
সরকারি চাকরিতে ন্যায্যতার দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। মামলা ঝুলতে থাকায় এখন সরকারি চাকরি দূরের কথা, স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তাও তাঁরা পাচ্ছেন না। জামিনে মুক্ত শিক্ষার্থীদের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে, ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেননি অনেকে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকার শাহবাগ থানায় চারটি ও রমনা থানায় একটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল একটি মামলায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান এজাহারভুক্ত আসামি। বাকি চার মামলার কয়েক শ আসামির সবাই অজ্ঞাতনামা। মামলাগুলোর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় দুটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের বাসভবনে ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্যের মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের চারটি ঘটনা রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের দাবি, গত এপ্রিলে ওই মামলাগুলো হলেও জুলাই মাসের আন্দোলন দমাতে এগুলো কাজে লাগায় পুলিশ। কেননা, কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে তাঁরা ৩০ জুন থেকে নতুন করে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর পরপরই সামনের সারির আট নেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা, খুব দ্রুত এই মামলার নিষ্পত্তি হবে না, তাঁদের অব্যাহতিও দেওয়া হবে না। নেতারা মামলা নিয়ে ছুটোছুটিতে থাকলে কোটা সংস্কারের প্রক্রিয়াটাও থামিয়ে রাখা যাবে-এই ভাবনা থেকে তদন্ত চলবে ধীরগতিতে।
শিক্ষার্থীরা আরও অভিযোগ করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরকারীদের সঙ্গে সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের মিল রয়েছে। ওই লোকগুলো কারা এবং কাদের পরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৮ এপ্রিল রাতে ঢুকেছিল সে সম্পর্কে পুলিশ কিছু বলছে না।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার একটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রাশেদ খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলার ঘটনায়ও গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই মামলায় রাশেদকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদনে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ধানমন্ডি জোনাল টিম) দাবি ছিল, স্বার্থান্বেষী মহলের মদদে রাশেদ খান ওই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তদন্তে জানা যাচ্ছে।
তবে গোয়েন্দা বিভাগ ও সাইবার অপরাধ বিভাগের দুটি আলাদা সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, রাশেদের সঙ্গে স্বার্থান্বেষী কোনো মহলের যোগাযোগ এবং বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা হাত মিলিয়েছেন-এমন কোনো তথ্য তাঁরা পাননি। আর্থিক লেনদেনের হিসাবও সন্দেহজনক নয়।
জামিনে থাকা রাশেদ খান বলেন, দুই দফায় ১৫ দিনের রিমান্ডে মোট তিনটি দল তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বিএনপি আন্দোলনে ১২৫ কোটি টাকা দিয়েছে এমন একটা গুজব নিয়েও পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু কিছু পায়নি। উপাচার্যের বাসভবনে হামলার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ৮ এপ্রিল রাতে শাহবাগে পিঠে রাবার বুলেট লাগায় চারুকলার দেয়াল টপকে বাণিজ্য অনুষদে ঢুকে বসে ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশ গত ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি মামলার একটিরও তদন্ত শেষ করতে পারেনি। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া ও জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত এখনো চলছে। স্বার্থান্বেষী মহলের মদদ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশ অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করছে।
পুলিশের অভিযোগ, শিক্ষার্থীরা যা বলছেন
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় রাশেদ খানের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. সজীবুজ্জামান। তিনি আদালতে রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, ‘জাতীয় সংসদে কোটা প্রথা বাতিলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং প্রজ্ঞাপন ঘোষণার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এ অবস্থায় রাশেদ খান ফেসবুক লাইভে এসে প্রধানমন্ত্রীর মানহানি ঘটায় এবং মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ায়। সে সুপরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছে। রাশেদের কাছ থেকে ডিজিটাল আলামত, ফেসবুক আইডি উদ্ধার, অজ্ঞাত সহযোগী আসামিদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করতে আসামিদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া প্রয়োজন।’
রাশেদের অজ্ঞাত সহযোগীদের চিহ্নিত করা গেছে কি না কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে মানহানি করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে কি না, জানতে চাইলে সজীবুজ্জামান বলেন, ‘এটা এভাবে বলা যাবে না।’
৫৭ ধারার আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন গাজীপুর ভাওয়াল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র শাখাওয়াত হোসেন। সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক এস এম শাহজালালের করা ওই মামলার এজাহারে শাখাওয়াত হোসেনের বিষয়ে বলা হয়, তিনি ফেসবুকের এক পোস্টে গাজীপুরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এসব পোস্টের মাধ্যমে আসামিরা আন্দোলনের নামে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন।
রাশেদ ও শাখাওয়াতের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনার আলিমুজ্জামান বলেন, তদন্তাধীন অবস্থায় কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না। আর তদন্ত শেষ হতে বেশ সময় লাগবে।
হামলার শিকার ছাত্ররাই আসামি
আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের নেতারা যাঁদের ওপর হামলা করেছেন তাঁদের পাঁচজনকে পুলিশ পরে সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এ পি এম সুহেল ৮ জুলাই তাঁর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন এবং আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। বাকি পাঁচজন আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, পুলিশই আদালতে আসামিদের হাজির করে জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী জসিম উদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারিকুল ইসলাম ও ফারুক হোসেন প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হলে পুলিশি পাহারায় তাঁদের চিকিৎসা করা হয়।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক সদস্যের মোটরসাইকেল পোড়ানোর মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মশিউর রহমানকে। তিনিও পুলিশি পাহারাতেই চিকিৎসা নিয়েছিলেন। মশিউর বলেন, ‘আমি ৩০ জুনই বাড়ি থেকে ঢাকায় আসি। আমাকে সূর্য সেন হলের ২৩৮ নম্বর রুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ছাত্রলীগ পিটিয়ে শাহবাগ থানায় দিয়ে আসে। পরে পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে মামলা দিয়ে দেয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে ভয়
২১ আগস্ট জামিনে মুক্তির পর গত ৫ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজিরা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এঁদের একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদুর রহমান। গত ৬ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা দিতে হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে গেলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। থানায় জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মাসুদ জানান তিনি মুসলিম নন। সত্য ধর্মের অনুসারী। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বেশ কিছু জেলায় ও পশ্চিমবঙ্গে সত্য ধর্মের অনুসারীরা আছেন। রমনা থানার পুলিশ তাঁর ধর্ম নিশ্চিত হতে শারীরিক পরীক্ষা করেছেন।
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাঈনুল ইসলাম এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এই নামের কারও কথা তাঁর মনে পড়ছে না। তবে এভাবে কাউকে পরীক্ষা করা হয়নি। তবে অভিযোগকারী ছাত্রটি যে উপপরিদর্শক তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন, সেই নামে রমনা থানায় একজন উপপরিদর্শক আছেন বলে থানা সূত্র নিশ্চিত করেছে।
শরীরের কষ্টের চেয়েও এখন বড় কষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে না পারার। রাশেদ খানকে ১ জুলাই যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাহফুজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র। গ্রেপ্তারের সাত দিন পরই তিনি জামিনে মুক্তি পান। হলে উঠেছেন ঠিকই। কক্ষ থেকে ভয়ে নিচে নামেন না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্য নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতেই পারেননি। রাশেদ খান বলছিলেন, ১৯ জুলাই এমবিএতে ভর্তির শেষ তারিখ ছিল। এখন পর্যন্ত ভর্তি হতে পারেননি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, সবকিছু বিবেচনায় পুলিশ তদন্তটা একটু দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করতে পারে। যত দেরি হবে এই শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিও তত দীর্ঘ হবে। সাধারণত অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিচার হয়, না হলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে নাম বাদ গিয়ে আসামিরা অব্যাহতি পান। তদন্তে তাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে তাঁরা মুক্তি পেতে পারেন।
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com