কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তিদের নির্বাচন করে স্বীকৃতি দেবে সরকার। পাঁচ বিভাগে সর্বোচ্চ ৪০ জনকে ‘কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এগ্রিকালচারাল ইম্পর্ট্যান্ট পারসন- এআইপি)’ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এজন্য একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
নীতিমালাটি চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রতি বছর ২৬ থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এআইপি কার্ড বিতরণ করা হবে।
খসড়া অনুযায়ী, ‘কৃষি উদ্ভাবন (জাত বা প্রযুক্তি)’ বিভাগের সর্বোচ্চ পাঁচজন এআইপি নির্বাচিত হবেন। ‘কৃষি উৎপাদন বা বাণিজ্যিক খামার স্থাপন ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প’ বিভাগের সর্বোচ্চ ১৫ জন (একটি প্রশাসন বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ দুজন), ‘কৃষি পণ্য রফতানি’ বিভাগে সর্বোচ্চ ১০ জন, ‘স্বীকৃত বা সরকারের রেজিস্ট্রিকৃত কৃষি সংগঠন’ বিভাগে সর্বোচ্চ পাঁচজন এবং ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরষ্কারে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত’ বিভাগের সর্বোচ্চ পাঁচজন এআইপি নির্বাচিত হবেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, ‘কৃষিশিক্ষা, গবেষণা, কৃষিপণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দেশের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সরকার কৃষি খাতসহ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কৃষিবিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা, উৎপাদনকারী, বাণিজ্যিক কৃষি খামার স্থাপনকারী, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী ও কৃষি সংগঠক বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্য থেকে সরকার প্রতি বছর কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষিতে অবদান রাখা ব্যক্তিদের আমরা সম্মানিত করতে চাই। তারা কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। এ সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করার কাজ প্রক্রিয়াধীন।’
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করে আগামী বছর থেকে প্রথমবারের মতো এআইপি নির্বাচিত করা সম্ভব বলেও জানান কৃষি সচিব।
রফতানি বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি-রফতানি), বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণকারী হিসেবে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অনাবাসি বাংলাদেশিদের সিআইপি, শিল্পে অবদানে বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি-শিল্প) নির্বাচন করা হয়ে থাকে। এখন কৃষিক্ষেত্রেও অবদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচনের উদ্যোগে নেয়া হলো।
‘কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচন নীতিমালা- ২০১৯’ নামে একটি নীতিমালার খসড়া করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এটি সংক্ষেপে ‘এআইপি নীতিমালা- ২০১৯’ নামে পরিচিত হবে।
খসড়া নীতিমালায় এআইপি নির্বাচনের শর্তে বলা হয়েছে, ‘কৃষি উদ্ভাবন (জাত বা প্রযুক্তি)’ ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে সব ধরনের দানাদার শস্য (যেমন- ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি) সবজি, ফলমূল এবং কন্দাল ফসল, মসলা ও পাট জাতীয় কৃষিপণ্যের নতুন জাত ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং এর উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে হবে।
উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তির মাঠপর্যায়ের ফলাফলের প্রমাণ থাকতে হবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা বা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকপর্যায়ে কৃষিতে অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করেছেন- এমন গবেষক, বিজ্ঞানী বা শিক্ষাবিদ হতে হবে আবেদনকারীকে।
‘কৃষি উৎপাদন বা বাণিজ্যিক খামার স্থাপন ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প’ বিভাগে আবেদনকারীকে মোট ফসল উৎপাদনের পরিমাণ, আবাদকৃত জমির পরিমাণ, ফলন, উৎপাদন খরচ, বিনিয়োগ ও লাভের তথ্য দিতে হবে। খামারে জমির পরিমাণ, নিয়োজিত লোকবল, ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির তালিকা, বার্ষিক লাভ, ব্যাংক হিসাব ইত্যাদি তথ্য জমা দিতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্জনের যথাযথ প্রমাণক দাখিল করতে হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
‘কৃষিপণ্য রফতানি’ বিভাগে একটি পঞ্জিকা বছরের জন্য এআইপি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আগের অর্থবছরের রফতানির পরিমাণ, রফতানি আয়, উৎপাদন, অর্জন বিবেচনা করা হবে। রফতানিকারক বিবেচ্য অর্থবছরে কোনো নতুন বাজার সম্প্রসারণে সক্ষম হয়েছেন কি না- তাও বিবেচনা করা হবে। ন্যূনতম রফতানি আয় থাকলে দেশীয় রফতানিকারকরা এআইপি নির্বাচিত হওয়ার জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে পারবেন।
প্রতি বছর এআইপি নির্বাচনের সময় পাওয়া আবেদনের সংখ্যা এবং আবেদনকারীদের অর্জিত আয়ের ভিত্তিতে পণ্যওয়ারি বিভাজন কৃষি মন্ত্রণালয় প্রয়োজন অনুযায়ী কম বা বেশি করতে পারবে। মন্ত্রণালয় প্রয়োজনে নতুন পণ্য বা খাত সংযোজন করতে পারবে এবং যে কোনো পণ্য বা খাত বিলুপ্ত করতে পারবে। রফতানি ক্ষেত্রে আবেদনকারীর ন্যূনতম রফতানি ও প্রচ্ছন্ন রফতানি আয় শূন্য দশমিক ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে হবে।
‘স্বীকৃত বা সরকার কর্তৃক রেজিস্ট্রিকৃত কৃষি সংগঠন’ বিভাগে কৃষি পেশাজীবী সংগঠন (সরকারি কর্মচারী ছাড়া), কৃষি ব্যবসায়ী সংগঠক, কৃষি-সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন মনোনীত সদস্যদের মধ্য থেকে এআইপি নির্বাচন করা হবে।
‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরষ্কার স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত’ বিভাগে যে বছরের জন্য এআইপির আবেদন আহ্বান করা হবে এর আগের বছরে বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরষ্কার স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এ বিভাগের আওতায় এআইপি হিসেবে নির্বাচিত হবেন।
এআইপি নির্বাচনে সাধারণ শর্তাবলী
এআইপি আবেদনপত্রে আবেদনকারীকে তার পিতা-মাতার পূর্ণ নাম, টিআইএন এবং ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) উল্লেখ করতে হবে। এআইপি হতে আবেদনকারী ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিলে এবং তা প্রমাণিত হলে ওই আবেদনকারী পরবর্তী তিন বছর এআইপি নির্বাচনের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। এছাড়া এআইপি হিসেবে নির্বাচিত ব্যক্তির তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হলে তার মনোনয়ন বাতিল করা হবে এবং পরবর্তী তিন বছর মনোনয়ন পাবেন না।
আদালতের সাজাপ্রাপ্ত বা অন্য কোনো কারণে অবাঞ্চিত বিবেচিত ব্যক্তি এআইপি হওয়ার যোগ্য হবেন না। তবে সাজা ভোগের পাঁচ বছর পর সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে যোগ্য হবেন। কর বকেয়া থাকলে কিংবা ঋণখেলাপি হলে এআইপি নির্বাচনের জন্য বিবেচিত হবেন না। আবেদনকারী করদাতা হলে আবেদনপত্রের সঙ্গে আয়কর প্রত্যয়নপত্র দাখিল করতে হবে এবং করদাতা না হলে তা উল্লেখ করে নিজে প্রত্যায়ন দিতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় দুটি কমিটির মাধ্যমে এআইপি নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের (সম্প্রসারণ) নেতৃত্বে থাকবে প্রাথমিক বাছাই কমিটি এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে থাকবে চূড়ান্ত বাছাই কমিটি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত বাছাই কমিটির সুপারিশ কৃষিমন্ত্রীর অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর এআইপি কার্ড আনুষ্ঠানিকভাবে বিতরণ করা হবে।
এআইপিদের তালিকা চূড়ান্ত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে ছাড়পত্র বা মতামত গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে ৩০ দিনের মধ্যে মতামত পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই বলে বিবেচিত হবে।
এআইপি নির্বাচনে প্রতি বছর ১৫ জুলাই থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি প্রচার এবং দরখাস্ত আহ্বান ও গ্রহণ করবে। প্রাথমিক বাছাই কমিটি ১৬ আগস্ট থেকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের কাজ শেষ করবে। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত বাছাই কমিটি বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামত নেবে।
২৬ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়কে এআইপি নির্বাচন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কার্যক্রম ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন গ্রহণ শেষ করতে হবে ১ থেকে ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে। প্রতি বছর ২৬ থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এআইপি কার্ড বিতরণ করা হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচিত এআইপিদের তালিকা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হবে।
যেসব সুযোগ-সুবিধা পাবেন এআইপিরা
একজন এআইপি সচিবালয়ে প্রবেশের জন্য পাস পাবেন। বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান ও সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় আমন্ত্রণ পাবেন। বিমান, রেল, সড়ক ও জলপথে ভ্রমণকালীন সরকারি গণপরিবহনে আসন সংরক্ষণ অগ্রাধিকার পাবেন।
একজন এআইপির ব্যবসা বা দাফতরিক কাজে বিদেশে ভ্রমণের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিসা পেতে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে উদ্দেশ্য করে লেটার অব ইন্ট্রোডাকশন ইস্যু করবে।
একজন এআইপি তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মাতা, পিতা ও নিজের চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালের কেবিনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন এবং বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ-২ ব্যবহারের সুবিধা পাবেন।
এআইপির মেয়াদ হবে এক বছর। এক বছর পার হওয়ার পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবলুপ্ত হবে। এআইপি কার্ডের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে এআইপি কার্ডটি কৃষি মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে।