কখনো কখনো পরিবেশ-পরিস্থিতির কারনে অনেক কিছু ঢাকা পড়ে যায়। যেমন ঢাকা পড়ে গেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলা মোহাম্মদ মিঠুনের ৬৮ রানের ইনিংসটির কথা। সবার মুখে শুধু মুশফিকুর রহীম বন্দনা।
ধ্বংস্তুপের মাঝে দাড়িয়েও বীরের মত লড়ে ক্যারিয়ার সেরা এবং সবচেয়ে বড় শতক উপহার দিয়ে আগের রাতে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক মুশফিক। চারিদিকে এখন যত কথা তাকে নিয়েই।
প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন মুশফিক। পাশাপাশি তামিমকে নিয়েও রাজ্যের আবেগ, উচ্ছাস ও ভালবাসা। তামিমের আন্তরিকতা ও দলের প্রতি মমত্ববোধ দেখে মুগ্ধ গোটা জাতি। এক হাতে প্লাস্টার নিয়েও দলের প্রয়োজনে এক হাতে ব্যাট করে মুশফিককে শেষ উইকেটে সাপোর্ট দিতে তার মাঠে নামা এবং দশম উইকেটে অবিচ্ছিন্ন ৩২ রানের জুটি গড়ে তামিম বনে গেছেন জাতীয় বীর।
সত্যিই আহত হয়ে মাঠ ছেড়ে ড্রেসিং রুম থেকে সোজা হাসপাতালে গিয়ে হাতে কব্জিতে প্লাস্টার করে দলের প্রয়োজনে এক হাতে ব্যাট করার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তামিম। দল তথা দেশের প্রতি তার এই ভালবাসা ও আন্তরিকতার কথা কাল রাত থেকেই সবার মুখে মুখে।
সাধারণত এমন ইনজুরির পর ব্যাট হাতে মাঠে নামার নজির খুব কম। কিন্তু কাল দুবাইয়ের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তামিম সে নজিরবিহীন ঘটনাই ঘটিয়েছেন। মানবিক দৃষ্টিকোণ এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের দিক থেকে বিচার করলে তামিমের এক হাতে ব্যাট করতে নামা অনেক বড় ঘটনা।
তামিম মাঠে নেমে চট জলদি আউট হয়ে ফিরলে কিংবা তারপর পরই মুশফিক আউট হয়ে গেলে হয়ত পরিবেশ-পরিস্থিতি ও চালচিত্র অন্যরকম হতো। কিন্তু তা হয়নি। তাই তামিম পাচ্ছেন বীরোচিত সম্মান।
কিন্তু সে তুলনায় তেমন কথা নেই মোহাম্মদ মিঠুনকে নিয়ে। মুশফিকের সাহসী ও বীরোচিত ব্যাটিং আর তামিমের সাহসীকতা ও দলের প্রতি আত্মনিবেদনের কথাই উচ্চারিত হচ্ছে বেশী।
সেটা অমূলক নয়। কালকের ম্যাচের প্রেক্ষাপটে যথার্থ। কিন্তু মোহাম্মদ মিঠুনও কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। শনিবার ম্যাচের প্রথম ওভারে ওপেনার লিটন দাস ও ওয়ান ডাউনে নামা সাকিব আউট হবার পর যে অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হয়েছিল, মুশফিকুর রহিম আর মোহাম্মদ মিঠুন সে খাদের কিনারায় দাড়িয়েও লড়াই করে দলকে টেনে ওপরে তুলেছেন।
অধিনায়ক মাশরাফি ও মুশফিক মিঠুনের সাহসী এবং সংকট বিপর্যয়ে মাথা তুলে দাড়ানোর অকুন্ঠ প্রশংসা করেছেন। আলাদা করে মিঠুনের কথা বলতে গিয়ে টাইগার অধিনায়ক বলেছেন, ‘খুব চাপের মুখে মিঠুন খেই না হারিয়ে চাপ সামলে দিয়েছে।’
পরিসংখ্যানও কিন্তু সে সাক্ষীই দিচ্ছে। কাল মিঠুন যখন উইকেটে যান, তখন বাংলাদেশের কি করুণ অবস্থা! ১ রানে নেই দুই উইকেট। আর দলের রান যখন মোটে ৩, তখন কব্জিতে ব্যথা পেয়ে মাঠ ছেড়েছেন তামিম। এরকম কঠিন পরিস্থতিতে মাঠে নেমে শুরুতে অল্প কিছু সময় আড়ষ্ট থাকা অস্বাভাবিক নয়।
মিঠুনও তেমন আড়ষ্টই ছিলেন। একদম শুরুতে মাত্র ১ রানে লাসিথ মালিঙ্গার বলে লঙ্কান অধিনায়ক ম্যাথুজের হাতে শর্ট মিডউইকেটে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গেছেন। সামনে শরীর ছুড়ে বল দু’হাতে নিয়েও তা ধরে রাখতে পারেননি লঙ্কান ক্যাপ্টেন। তার হাত ফসকে বল বেড়িয়ে যায়। তারপর অতি দ্রুত নিজেকে পরিবেশ -পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেন মিঠুন। মুশফিকের সাথে ১৩১ রানের পার্টনারশিপে ৬৮ বলে ৬৩ রানের সাহসী ও লড়াকু ইনিংসও উপহার দেন।
শেষ পর্যন্ত ১৩৭ রানের বড় জয় ধরা দেয়ায় তার কৃতিত্ব ও অবদানটা সেভাবে উচ্চারিত হচ্ছেনা। কিন্তু ক্রিকেটীয় হিসেব নিকেশ এবং ম্যাচের চালচিত্রকে নিয়ামক ধরলে মিঠনের ৬৩ রানের ইনিংসটি মহা মুল্যবান ও অত্যন্ত কার্যকর। ঐ সময় মিঠুন স্বল্প সময় ও সংগ্রহে সাজঘরে ফিরলে দলের অবস্থা আরও সঙ্গীন হতো। বিপদ-সংকট হতো আরও ঘনীভূত।
লিটন-সাকিব দুজনই শূন্য রানে আউট। তামিমও ব্যথা পেয়ে সাজঘরে। আর পরে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (১) ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও (১) কিছু করতে পারেননি। তাই বলেই দেয়া যায় মুশফিক ও মিঠুন জুটিই বাংলাদেশকে গভীর সংকট ও চরম বিপদ থেকে জয়ের পথ দেখিয়েছে। লড়িয়ে পুজি গড়ে দিয়েছে।
দলের প্রয়োজনে সিনিয়রদের পাশাপাশি তরুণদের উঠে আসার তাগিদ ছিল অধিনায়ক মাশরাফির কন্ঠে। শুধু টাইগার ক্যাপ্টেনই নন, বাংলাদেশ দলের ভক্ত-সমর্থক সবাই নিকট অতীত ও সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের উঠে আসা এবং সময়ের দাবি মেটানোর তাগিদ অনুভব করছিলেন। মিঠুনের দায়িত্বশীল ব্যাটিংকে তাই প্রয়োজন মেটানোর জ্বলন্ত নজির বলেই ভাবা হচ্ছে।
টিম বাংলাদেশ বেশ কিছু দিন ধরেই সিনিয়র বিশেষ করে ‘পঞ্চ পান্ডবের’ (মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ) ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগে ঘুরে ফিরে ঐ সিনিয়ররাই ত্রাতা। ত্রানকর্তার ভূমিকায়।
সেখানে সৌম্য, লিটন, এনামুল হক বিজয়, সাব্বির ও মোসাদ্দেকরা বেশীর ভাগ সময় ব্যর্থতার ঘানি টানায় হতাশার পাশাপাশি একটা শূন্যতাও তৈরী হয়েছিল। মিঠুনের দায়িত্বশীল ব্যাটিং সেই হতাশার অন্ধকারে আশার আলো। অন্ধকারে আলোকবর্তিকা। শুধু টিম বাংলাদেশের আলোকেই নয়। মিঠুনের নিজের জন্যও এমন কার্যকর ইনিংস খুব দরকার ছিল।
ঘরের ক্রিকেটে গত কয়েক বছর প্রায় সব ফরম্যাটে রান আছে তার। কিন্তু কেন যেন জাতীয় দলে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। যখন যে ফরম্যাটে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন, তাতেই ব্যর্থ হয়েছেন। অবশ্য আত্মসমর্পনের একটা বড় অস্ত্র মিঠুনের আছে। তা হলো কখনই একটি পুর্নাঙ্গ সিরিজ খেলা হয়নি তার। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে যথাক্রমে সাড়ে তিন ও দুই বছর পর জাতীয় দলের লাল সবুজ জার্সি গায়ে একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। আর তাতে রান না পাওয়ায় আবার বাদ পড়েছেন।
২০১৪ সালের ১৭ জুন থেকে এ বছরের ২৭ জানুয়ারী- সাড়ে তিন বছর পর তাই ওয়ানডে খেলার সুযোগ মেলেনি। দীর্ঘ দিন পর এবছর জানুয়ারীতে কিছু করতে পারেননি মিঠুন। অথচ মঞ্চটা বড়ই ছিল। ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারী শেরে বাংলায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন জাতি ক্রিকেটের ফাইনালে সুযোগ দেয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু ফিরে গিয়েছিলেন মাত্র ১০ রানে। কম রানে আউট হওয়াই শুধু নয়, স্ট্রাইকরেটও ছিল বেশ খারাপ; ৩৭.০৩। ঐ অনুজ্জ্বল ব্যাটিংয়ের পর মিঠুনের ওপর টিম ম্যানেজমেন্ট এবং নির্বাচকদের আস্থা কমে প্রায় শুন্যের কোঠায় চলে আসে।
জাতীয় দল থেকে নাম কাটা যায়। মিঠুনের জায়গায় হয় ‘এ’ দলে। গত আগস্টে তাকে পাঠানো হয় আয়ারল্যান্ডে। আইরিশ ‘এ’ দলের বিপক্ষে নিজেকে মেলে ধরেন মিঠুন। টি-টোয়েন্টি আর লিস্ট ‘এ’ ৫০ ওভারের ম্যাচে তিন তিনটি ‘বিগ ফিফটি’ হাকিয়ে জানান দেন, আমি পারি। আমার সামর্থ্য আছে অনভ্যস্ত কন্ডিশনে বড় ইনিংস খেলে দল জেতানোর। তারই প্রতিশ্রুতিতে এশিয়া কাপ স্কোয়াডে জায়গা পাওয়া।
ভেতরের খবর, এবার তাকে দলে নেবার আগে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মিঠুনের সাথে কথা বলেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। আকার-ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয়া হয়, এশিয়া কাপে তাকে খেলানো হবে। এটাই তার সামর্থ প্রমাণের সেরা মঞ্চ। এখানে ব্যর্থ হলে সহসা আর ডাক নাও আসতে পারে।
মিঠুন নিজেও তা জানতেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, ‘জানি এবার ভাল না করতে পারলে আগামীতে দলে ফেরা কঠিন হবে।’ সেই অনুভব, উপলব্ধিটাই লঙ্কানদের বিপক্ষে ভাল খেলার পথে সবচেয়ে বড় রসদ হিসেবে কাজ করেছে।