সাম্বার ছন্দ কেটে গেছে বহুদিন হলো। পাল্টেছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ধাঁচ। রক্ষণ ভুলে আক্রমণে উঠতে এখন দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়। মাঝমাঠে কবিতার পংক্তির মতো ছন্দোবদ্ধ ছোট ছোট পাসের সেই খেলাও অতীত হতে বসেছে। তাতে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ছন্দের নদীটাও ধীরে ধীরে শুকিয়ে এসেছে। ফিলিপে কুতিনহো যেন এই শুকিয়ে আসা নদীরই এক উথাল-পাতাল শাখা-নদী!
তিতের ব্রাজিলে নিঃসন্দেহে নেইমার সবচেয়ে বড় তারকা। সবচেয়ে দামি ফুটবলারও। কিন্তু চোটের কারণে সমর্থকদের প্রত্যাশার প্রতিদানটা সেভাবে দিতে পারছেন না। তবে পায়ের পুরোনো ঝলকটা যে ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছেন তা ব্রাজিলের এই তিন ম্যাচে বোঝা গেছে। অবশ্য নেইমার সাড়া দিতে দেরি করলেও তাতে ব্রাজিল দলের ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। বাকিরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এই ব্রাজিল শুধু নেইমারের ওপর নির্ভরশীল নয়।
এই বাকিদের মধ্যে কুতিনহোই সবচেয়ে উজ্জ্বল। সবচেয়ে ক্ষুরধারও। প্রমাণ চাই? গ্রুপপর্বে ব্রাজিলের তিন ম্যাচে ফিরে তাকালেই তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এই তিন ম্যাচে ব্রাজিল ৫ গোল করেছে। এর মধ্যে ৩ গোলে কুতিনহোর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অবদান। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে তাঁর বাঁকানো শটে করা গোলটা তো টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এরপর কোস্টারিকার বিপক্ষে ব্রাজিল গোলের খাতা খুলেছিল এই কুতিনহোর গোলেই। আর আজ পাউলিনহোকে দিয়ে যে গোলটা করালেন সেটির চেয়ে তাঁর পাসটাকেই ব্রাজিলিয়ান সমর্থকেরা হয়তো বেশি দিন মনে রাখবেন। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের একটা অলিখিত পরম্পরা আছে। নদীর স্রোতের মতো একের পর এক আসতেই থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেই ধারা প্রায় শুকিয়ে গেলেও মাঝমাঠে কুতিনহো দেখলেই অদৃশ্য সেই পরম্পরা মনে পড়বেই।
নিকট অতীতে ফিরে তাকালে দেখা যায় রিভালদো, রোনালদিনহো কাকাদের। আরেকটু পেছনে গেলে উঁকি দেবেন জিকো, ফ্যালকাও, সক্রেটিস, গারসন, রিভেলিনো, জর্জিনহোরা। গোল করা আর গোলের সুবাস ছড়াতে ওস্তাদ এইসব কিংবদন্তি মিডফিল্ডারদের বর্তমান উত্তরসূরী হয়তো কুতিনহো। তাঁর খেলাটা আসলে কেমন? এই প্রশ্নের জবাব পেতে আগে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডের খেলার ধাঁচটা বোঝা জরুরি।
ধরুন, একটা খরস্রোতা নদীর এদিকে-সেদিকে ছড়ানো ছিটানো প্রচুর পাথর। স্বাভাবিকভাবেই তাতে নদীর স্রোত আটকে যাওয়ার কথা। কিন্তু পাথর তা আটকাতে পারে কি? নদীর স্রোত ঠিকই পাথরের ফাঁক গলে এগিয়ে চলে আপন পথে। লাতিন সৌরভময় ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডের খেলাও ঠিক এ রকম। প্রতিপক্ষ মাঠের সবুজ গালিচায় পাথরের মতো বাধা সৃষ্টি করলেও তাঁদের ফাঁক গলে ঠিকই পাসের ফুল ফোটে। ঠিক যেমন পাউলিনহোকে দেওয়া কুতিনহোর পাসটা!
শুধু সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটাই বিশ্লেষণ করে দেখুন। ৯১ শতাংশ পাসিং অ্যাকুরেসি, সফল পাস ৫০টি, এর মধ্যে গোলের সুবাস ছড়ানো পাস ছিল তিনটি। সেখান থেকে একটি গোলও হয়েছে। দুইবার বল দখলে নেওয়া ছাড়াও আরও সফল ট্যাকল করেছেন আরও দুবার—এসবই কুতিনহোর পরিসংখ্যান। কিন্তু পরিসংখ্যান একটা আস্ত গাধা। তা না হলে মাঝমাঠে সার্বিয়ার কজন খেলোয়াড়কে নিয়ে কুতিনহো যে ছেলেখেলা করলেন, পরিসংখ্যান তো তা মনে রাখেনি!
কিন্তু ফুটবলপ্রেমীরা এসব মনে রাখেন। বিশেষ করে ফুটবলের প্রবীণ রসিকজনের মনে কুতিনহো ফিরিয়ে এনেছেন পেলেকে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে নিজের প্রথম তিন ম্যাচেই গোল কিংবা ‘অ্যাসিস্ট’ ছিল পেলের। তারপর প্রথম ব্রাজিলিয়ান হিসেবে কুতিনহোও বিশ্বকাপে নিজের প্রথম তিন ম্যাচেই একই পথে হেঁটে ফিরিয়ে এনেছেন পেলের স্মৃতি। তবে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এসব সংখ্যা-উপাত্তের চেয়ে খেলার ধাঁচের প্রাধান্যই বেশি । কুতিনহোর নিখাদ ব্রাজিলিয়ান ধাঁচ আপাতত সব বাধা উতরে যাচ্ছে—যেভাবে পাথরের বাধা উতরে নদী এগিয়ে চলে।