কিছু শূন্যতা আজীবন রয়ে যায়

:
: ৬ years ago

আমি তখন সপ্তম শ্রেণির বালিকা। এক শুক্রবার বিকেলে নানু বাড়িতে যাচ্ছি। এফডিসির সামনে গাড়ি আটকে গেল। বিশ্রী জ্যাম। কোনো যানবাহন এক চুলও নড়ছে না। বিরক্ত ও অধৈর্য হয়ে আমার বাবা মাথা বাড়িয়ে পাশে যে বেবিট্যাক্সি ছিল তার চালককে জিজ্ঞেস করলেন এই অবস্থা কেন, কিছু হয়েছে নাকি? সেই চালক উত্তর দিলেন—‘এক নায়ক মারা গেছে আজকে। একটু আগে তার লাশ এইখানে আনছে। পাবলিক সব এখন এফডিসির ভেতর ঢুকতে চায়, তাই সব আটকায়ে গেছে।’ বাবা কিছু বলার আগেই আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম কোন নায়ক? চালক বললেন, সালমান শাহ। আমি কয়েক মুহূর্ত অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে উঠলাম, যাহ, কী বাজে কথা বলে এই লোক? আন্দাজে একটা নাম বলে দিলেই হয় নাকি?

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম কথাটা মোটেও বাজে বা ভুল নয়। যেই মানুষটা মারা গেছেন তিনি সত্যিই সালমান শাহ। মুহূর্তের মধ্যে কোথায় আছি, আশপাশে কী হচ্ছে সব এলোমেলো হয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই টের পেলাম আমি ব্যাকুল হয়ে কাঁদছি আর বাবা আমাকে মৃদু স্বরে ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করছেন এই বলে যে, ‘রাস্তাঘাটে এসব কী সিনক্রিয়েট! লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে, কান্না বন্ধ করো।’ আমি কান্না থামানোর চেষ্টা করেও সফল হতে পারলাম না। কোনোভাবেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না, কী করে এ রকম একজন অল্পবয়স্ক তরতাজা প্রাণ, এত অসম্ভব প্রিয় আর পরিচিত একটা মুখ এত ভয়ংকর অপ্রত্যাশিত ভাবে পৃথিবী থেকে চলে যেতে পারে? আমার এখনো মনে আছে, সেই বেবিট্যাক্সি চালক দুঃখিত মুখে বলেছিলেন, আহারে আমি যদি জানতাম আপনে এই নায়করে এত পছন্দ করেন, তাহলে এই খবর আপনারে দিতাম না।

দিনটি ছিল ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। যে বয়সের কথা বলছি সে বয়সে ভক্ত কাকে বলে বুঝতাম না। আর একজন ভক্ত কী কী করে সেগুলো কিছুই জানতাম না। সিনেমা হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখার কথা আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ ভাবতেও পারত না। বাড়িতে সিনেমার পত্রপত্রিকা আসা নিষেধ ছিল। তাই তাঁর কোনো ইন্টারভিউও কখনো পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। তবু পছন্দ ছিল, বেশ অনেক খানিই ছিল। ১৯৯৩ সালে যখন তাঁর প্রথম ছবিটি সারা দেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল, তখন সকলের সেই পাগলামোর ছোঁয়া আমারও লেগেছিল বৈকি।

লেখিকাতখন অনেক ছোট ছিলাম। আশপাশের সবাই যখন এসে গল্প করত, তাদের কথা শুনে শুনে আমার এক অদম্য আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল ছবি ও ছবির নায়কটির প্রতি। খুব স্পটভাবে মনে আছে, সেই সময় বহু শিক্ষিত লোকজন ছবিটি দেখেছিলেন এবং নায়কের স্মার্টনেসের গালভরা প্রশংসা করেছিলেন। বাংলাদেশে সম্ভবত এর আগে এ রকম সর্ব শ্রেণির মন জয় করা নায়ক আসেননি। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে এলিট ক্লাস পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে সালমান শাহকে পছন্দ করেছিলেন। প্রতিটি শ্রেণির দর্শকদের নিজের দিকে টানার কারিশমা তার ছিল। এ রকম একজনকে ভালো না লাগার কোনো কারণ নেই। আর সিনেমা দেখা হতো না সত্যি, কিন্তু টিভি তো ছিল। টিভিতে তার ছবির গান, তার ইন্টারভিউ, ম্যাগাজিনে অনুষ্ঠান ও প্যাকেজ নাটকে তার উপস্থিতি—এগুলো সব দৃষ্টিগোচর করতে কার্পণ্য ছিল না। দেশে একজন নায়কের মতো নায়ক আছেন এটা জানতাম। সেটুকুই ভালো লাগা আর সেটাই ছিল সান্ত্বনা। সেই মানুষটার চলে যাওয়া কি সহজে মেনে নেওয়া যায়?

আজ তিনি নেই বাইশ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু তার প্রতি মানুষের সেই ক্রেজ, সেই ভালোবাসা এখনো অটুট আছে। তার কথা মনে পড়লে এখনো দারুণ একটা আক্ষেপ হয়। মনটা হাহাকার করে ওঠে। এই সেপ্টেম্বর মাসটা বড় অদ্ভুত। এই মাসেই সালমান শাহর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। জন্মের দিনের কথা আগে বলতে হয়। কিন্তু তার বেলায় সেটা বলা যায় না। কারণ তার মৃত্যুদিন জন্মদিনের আগে আসে। ৬ সেপ্টেম্বর তার প্রয়াণ দিবস ও ১৯ সেপ্টেম্বর জন্মদিবস। প্রতিবছর এই মাসটি এলে নতুন করে তাঁর মৃত্যু রহস্য নিয়ে নানান কথা, গবেষণা ও লেখালেখি শুরু হয়। হত্যা না আত্মহত্যা! কেন এই অকালমৃত্যু? সত্যি করে কী হয়েছিল সেদিন? এই রহস্যের জোট কোনো দিন কী খুলবে? হাজারো প্রশ্ন আর আলোচনা। এভাবে চলে পুরোটা মাস। একসময় তা থিতিয়ে পড়ে এবং পরের বছর একই কথা, একই প্রশ্ন আবার ঘুরে ফিরে আসে।

নব্বইয়ের দশকে যখন অতি অভিনয়ের প্রচলন ছিল, জোরে জোরে চিৎকার করে কথা বলা, অতিরঞ্জিতভাবে মুখভঙ্গি করাকেই সিনেমার জন্য যথাযথ অভিনয় বলা হতো, সেই সময় প্রথার বাইরে গিয়ে তিনিই একমাত্র ছিলেন যিনি সহজাত, সাবলীল অভিনয় নিয়ে এগিয়ে আসেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের ক্যারিয়ার। ২৭টি ছবি। যার কোনটিই সেইরকম গল্পভিত্তিক বা মিনিংফুল সিনেমা নয়। যে ধরনের মেইন স্ট্রিম সিনেমা তিনি করেছেন সেগুলোতে কোনো অভিনেতার পক্ষে নিজেকে শক্তিশালী অভিনয় শিল্পী প্রমাণ করা সম্ভব নয়। যারা ছবি বোঝেন, ছবি দেখেন, তারা সালমান অভিনীত ছবিগুলো দেখতে বসলে ধৈর্য ধরে পুরো ছবি দেখতেও হয়তো পারবেন না সেগুলোর দুর্বল ও সেকেলে নির্মাণের জন্য। কিন্তু শুধু যদি সালমানের অভিনয় দিয়ে আমরা বিচার করি তাহলে তা আজ এই এত বছর পরও আকর্ষণীয় ও যথেষ্টই আধুনিক। পোশাক ও স্টাইলিংয়ে নিজের সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকার কথা তো ছেড়েই দিলাম। কাজের ক্ষেত্রেও মানে ২২ বছর আগে তিনি যেই স্টাইলে ডায়ালগ দিয়ে গেছেন, এক্সপ্রেশন দিয়েছেন, অভিনয় করেছেন সেটাও যেন আমাদের এই বর্তমান যুগকেই রিপ্রেজেন্ট করে।

বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে এ রকম বিরল ক্যারিয়ার গ্রাফ মনে হয় না আর কোনো অভিনেতার আছে। সুপারহিট নায়ক হিসেবে যখন একের পর এক ছবি করে যাচ্ছেন, ওই ভয়ংকর ব্যস্ততার মধ্যেই একটি টিভির একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেন। ইতিকথা নাটকটিতে ফেরদৌসী মজুমদার, গোলাম মোস্তফা, আবুল খায়ের ও শমী কায়সারদের মতো টিভি ও মঞ্চের তুখোড় শিল্পীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কী দুর্দান্ত অভিনয়টাই না তিনি করেছেন! এত বছর পর যখন ইউটিউবে নাটকটি দেখলাম, সত্যি বলছি অবাক হয়ে শুধু তাকেই দেখেছি। কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না, ঠিক একই সময় মানুষটা বাণিজ্যিক ছবিতে নাচছেন, গাইছেন, ফাইট করেছেন আবার এ রকম নন-গ্ল্যামারাস একটি নাটকে এসে নিজেকে ভেঙে এমন শৈল্পিক ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। প্রতিটি ফ্রেমে প্রমাণ করেছেন অভিনেতা হিসেবে তিনি কতটা উঁচু দরের। আর সেই অভিনেতা হিসেবেই মানুষটিকে কখনো তার যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি।

সত্যিকার অর্থে আমরা এযাবৎ শুধুই তাকে স্টাইল আইকন, সবচেয়ে গুড লুকিং হিরো এসব উপাধিতে বারবার ভূষিত করে স্মরণ করেছি, এর বেশি কিছু নয়। তার করা ও রেখে যাওয়া কাজগুলোকে কি সেভাবে শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছি আমরা? নাহ। একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে, সঠিক উপায়ে তার জন্য গঠনমূলক কিছু করা হয়েছে কি? প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাস আসলে বিভিন্ন চ্যানেল এ তাকে নিয়ে কয়েকটি স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান করাটাই কি যথেষ্ট? কত মানুষকে কতভাবে সাহায্য করেছেন তিনি, বিপদে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কত লোকের সংসার শুধু তার টাকায় চলত, সেসব শুধু তার মৃত্যুদিন এলে আবেগতাড়িত গলায় স্বীকার করলেই কি সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? সে যুগে কক্সবাজারে সেরকম হোটেলের সুবিধা ছিল না। তাই তিনি শিল্পীদের সবার শুটিংয়ের সুবিধার জন্য কক্সবাজারে একটি জমির বায়না পর্যন্ত করেছিলেন। অনেক প্ল্যান ছিল তার…অনেক কিছু করার ইচ্ছে ছিল। সবইতো ইন্ডাস্ট্রির কল্যাণের উদ্দেশ্যে। সেই ইন্ডাস্ট্রি আজ পর্যন্ত কী করেছে তাঁর জন্য? টিভিতে ডাকা হলে, এসে দুটো ভালো লাইন বলে গেলেই যেন সব ফুরিয়ে যায়।

সালমান শাহের কোনো ইন্টারভিউ গুগল বা ইউটিউবে নেই। অভিনীত সিনেমাগুলো ভালো প্রিন্টে ইংলিশ সাবটাইটেলসহ সংরক্ষণ করার ব্যাপারে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একটা আর্কাইভ নেই। এফডিসিতে আজ পর্যন্ত কোনো ফ্লোর বা সড়ক তার নাম উৎসর্গ করা হয়নি। কেন এই অবহেলা? এই সামান্য সম্মানটুকু তো তার অধিকার, তার প্রাপ্য। তার স্মৃতি ধরে রাখার মতো যেসব সাক্ষাৎকার, ডকুমেন্টারি দরকার ছিল, সেগুলো হয়তো কখনো বানানোই হয়নি আর হলেও সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। এর চেয়ে হতাশার কী হতে পারে?

মৃত্যুর এত বছর পরও যার জনপ্রিয়তা একবিন্দু কমেনি তিনি আজ থাকলে কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াতেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। আরেকটু বেশি সময় যদি জীবন তাকে দিত তাহলে তিনিই সেই ব্যক্তি হতেন যার হাত ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিশ্বমানের দরজা পেত। আজ বলিউড আর হলিউড যখন গর্ব করে বলে তাদের কাছে শাহরুখ খান, আমির খান, সালমান খান, টম ক্রুজ, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও বা ব্র্যাড পিট আছে, আমরা সেরকম গর্ব করে কিছুই বলতে পারি না। আমাদের শুধু মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে হয়, আমাদেরও একজন ছিলেন যাকে বিশ্বের সামনে গর্বভরে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেত! এই ছিলেন আর আছেন শব্দ দুটোর মধ্যে কী করুণ ব্যবধান! আর মাঝখানে শুধু একটিই নাম, তিনি সালমান শাহ। এই শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়, এই কষ্ট কখনোই মুছে ফেলার নয়।

ক্ষমতাবানরা যা পারেন তা হয়তো সাধারণ মানুষেরা কখনোই করে দেখতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহর কাছে প্রিয় এই মানুষটার জন্য দোয়া চাওয়ার কাজটুকু তারা অবশ্যই করে যাবে। তিনি যেখানেই থাকেন, যেন অসম্ভব ভালো আর শান্তিতে থাকেন এই প্রার্থনা তার জন্য সব সময় থাকবে। সেই সঙ্গে কোথাও না কোথাও এই আক্ষেপও প্রতিধ্বনিত হবে, ‘হে প্রিয় নায়ক, এই দেশের মানুষ গুণীর কদর করে ধরে রাখতে জানে না, তাদের ক্ষমা করে দিয়ো।’

সারা বুশরা দ্যুতি: বেডফোর্ড, যুক্তরাজ্য।

শাবনূর ও সালমান শাহ অভিনীত ছবির দৃশ্য