কক্সবাজারের টেকনাফে মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার আগে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে ‘শেষ কথার’ যে অডিও রেকর্ড তার পরিবার প্রকাশ করেছে, তাতে পুরো মাদকবিরোধী অভিযান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। চারটি টেপ মিলিয়ে ১৪ মিনিট ২২ সেকেন্ডের ওই অডিও রেকর্ডে কয়েকজনের কণ্ঠ, গুলির শব্দ, গালাগালি আর চিৎকার শোনা গেছে। এই টেপটি সাংবাদিকদের শুনিয়ে একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা’ করা হয়েছে। যদিও একরামের স্ত্রীর সরবরাহ করা ওই অডিও টেপটি প্রতিদিনের সংবাদ স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। এদিকে, নিহতের বড়ভাই নজরুল ইসলাম বলেছেন, একরামের ফোন খোলা ছিল বলে এ প্রান্তে পুরো ঘটনাপ্রবাহ রেকর্ড হয়েছে ফোনের অটো-রেকর্ডারে। আর ফাঁস হওয়া ওই অডিও নিয়ে গত দু’দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে। এদিকে, একরামের স্ত্রীর সরবরাহ করা ওই অডিও টেপটি খতিয়ে দেখছে র্যাব সদর দফতর। গতকাল শুক্রবার র্যাবের পরিচালক (মিডিয়া) কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘অডিওটা আমরা শুনেছি। অনেক রকমের অডিও হয়, বিষয়টি আমরা দেখছি।’
গত ২৬ মে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে একরাম নিহত হন। এরপর র্যাব দাবি করে একরাম তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি। তবে গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নিহত পৌর কাউন্সিলরের স্ত্রী আয়েশা বেগম অভিযোগ করেন, বন্দুকযুদ্ধের নামে অন্যায়ভাবে তার স্বামীকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের একটি অডিও রেকর্ড দিয়ে বলেন, এটি ২৬ মে রাতে একরামুল নিহত হওয়ার সময়ের।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আয়েশা অভিযোগ করে বলেন, ‘২৬ মে রাতে একটি গোয়েন্দা সংস্থার মেজর পরিচয় দিয়ে আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় আমার স্বামী মোবাইলে আমার মেয়ে ও আমার সঙ্গে কথা বলেন। তখন তার কণ্ঠে আতঙ্ক ছিল। এরপর থেকে আমার মোবাইলটি সারাক্ষণ খোলা ছিল। এতে রেকর্ড হচ্ছিল। ওই দিন রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চিৎকার ও গুলির শব্দ শুনেই আমি ও আমার পরিবার আঁতকে উঠি। তখনই বুঝতে পারি আমার স্বামীকে অন্যায়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’
ফাঁস হওয়া অডিও টেপের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (জামাক) চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এ ধরনের হত্যাকান্ডের বিচারিক তদন্ত হওয়া দরকার। জামাকের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেছেন, আইনকে ‘পাশ কাটিয়ে’ কাজ করতে গেলে যে বিপদ ঘটতে পারে, একরামের ঘটনায় তা ‘স্পষ্ট হয়ে গেছে’। আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান একে বর্ণনা করেছেন ন্যায় বিচার, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের জন্য ‘অশনি সংকেত’ হিসেবে।
সারা দেশে চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে ১৩ দিনে নিহত ১২২ জনের মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক একজন, যিনি গত ২৬ মে রাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে র্যাবের ভাষ্য। টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুলকে ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি’ এবং ‘ইয়াবার শীর্ষ গডফাদার’ হিসেবে উল্লেখ করে আসছে র্যাব। তবে তার পরিবার বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
এদিকে, অডিও সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমি অডিওটি এখনো শুনিনি। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছে। যেহেতু এরকম একটি কথা এসেছে, এটা তো ইনকোয়ারি ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না। আমি বিষয়টি ইনকোয়ারি করে দেখব। তদন্তে কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন মন্ত্রী।
কি আছে সোয়া ১৪ মিনিটের সেই অডিও টেপে : ‘হ্যালো! আমি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। আমি উনার মিসেস বলতেছি, হ্যালো! হ্যালো!…’- উৎকণ্ঠায় উচ্চস্বরে এমনিভাবে কথা বলছেন মোবাইল ফোনের একপ্রান্ত থেকে। অপর প্রান্তের কথার স্বর অনুচ্চ। এর খানিক পর গুলির শব্দ উহ্ গোঙানি। এরপর আরেকটি গুলির শব্দ। এপাশে চিৎকার- ‘ও আল্লাহ’।
এমনি কিছু রক্ত ঠান্ডা করা কথোপকথনের পৃথক চারটি ক্লিপ মিলিয়ে ১৪ মিনিট ২২ সেকেন্ডের একটি অডিও ক্লিপ এসেছে দ্য ডেইলি স্টারের হাতে। ক্লিপটি সরবরাহ করেছেন কক্সবাজারে মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত পৌর কমিশনার একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম। গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মোবাইল ফোনে নারীর কণ্ঠটি তার।
স্বামীর খোঁজ নেওয়ার জন্যে আয়েশা ঘটনার দিন ১১টা ৩২ মিনিটে ফোন দিলে ফোনটি রিসিভ করা হয়। কিন্তু, একরাম কিছু বলছিলেন না। আয়েশা বলেন, ‘হ্যালো!… হ্যালো! হ্যালো কে? আমি কমিশনারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি। আমি উনার মিসেস বলতেছি, হ্যালো! হ্যালো!…’ এমন সময় ফোনের অপর পাশের অনুচ্চ স্বরে কথা শোনা যায়। পরক্ষণেই শোনা যায় ট্রিগার টানার শব্দও। তারপর গুলি। একপাশে ‘ও আল্লাহ’ বলে নারী ও শিশুকণ্ঠে আর্ত-চিৎকার শোনা যায়। ‘আমার জামাই কিচ্ছু করে নাই। আমরা বিনা দোষী।’-বলে একজন নারীর কান্না। ফোনের অপর পাশে বাঁশির ফুঁ, সাইরেনের শব্দ। আতঙ্কিত কণ্ঠে গালিগালাজের আওয়াজ। একপর্যায়ে একজন দুজন ব্যক্তির মধ্যে গুলি গণনার কথোপকথনও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।