করোনা প্রতিরোধের ছয়টি ভুল ধারণা

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে প্রতিমুহূর্তে। উপদ্রব শুরুর প্রায় তিন মাস হয়ে গেলেও এখনও কোনও প্রতিষেধক বা ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। যদিও ভারতের কিছু নেতা দাবি করেছেন, গোমূত্রেই রয়েছে সব সমস্যার সমাধান! এছাড়া ১৫ মিনিট পরপর পানি পান, বেশি বেশি রসুন খাওয়া, ক্লোরিন-মিশ্রিত পানিতে গোসলসহ বেশ কিছু পদ্ধতির কথা ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। তবে, এর বেশিরভাগেরই কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

চলুন জেনে নেয়া যাক করোনাভাইরাস প্রতিরোধ নিয়ে এ ধরনের কিছু ভ্রান্ত ধারণা-

১. ১৫ মিনিট পরপর পানি পান
এক ‘জাপানি চিকিৎসকের’ উদ্ধৃতি দিয়ে ফেসবুকে ঘুরেফিরেই একটি পোস্ট দেখা যাচ্ছে- করোনার সংক্রমণ এড়াতে ১৫ মিনিট পরপর পানি পান করুন। এতে গলা ভেজা থাকবে এবং ভাইরাস মুখে প্রবেশ করলেও পানির সঙ্গে তা পাকস্থলীতে চলে যাবে। সেখানকার জৈব অ্যাসিডের প্রভাবে করোনাভাইরাস আপনাআপনিই মারা যাবে।

তবে এ ধারণা সঠিক নয়। পানিপান স্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই উপকারী, তবে ১৫ মিনিট পরপর পানি পান করলে তা আপনাকে করোনার হাত থেকে বাঁচাবে, এর কোনও প্রমাণ নেই বা বিষয়টি প্রমাণিতও নয়।

২. রসুন
করোনা সংক্রমণ এড়াতে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ভাইরাল পরামর্শগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে- বেশি বেশি রসুন খাওয়া। বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকদের মতামত না শুনে অনেকে সেটি মানতেও শুরু করেছেন। সম্প্রতি চীনের এক নারী দেড় কেজি কাঁচা রসুন খেয়ে গলায় মারাত্মক প্রদাহ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

virus-3.jpg

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, রসুনের স্বাস্থ্যগত অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে, অনেকক্ষেত্রে এটি জীবাণুনাশকও। তবে, বেশি বেশি রসুন খেলে করোনাভাইরাস আক্রমণ করবে না- এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

৩. ‘আশ্চর্য’ দ্রবণ
জর্ডান স্যাথার নামে এক ইউটিউবার দাবি করছেন, ক্লোরিন ডাই অক্সাইড মিশ্রিত ‘মিরাকল মিনারেল সাপ্লিমেন্ট’ বা এমএমএস করোনাভাইরাস দূর করতে সক্ষম। ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারে জর্ডানের কয়েক লাখ অনুসারী (ফলোয়ার) রয়েছেন। তারা প্রচার করছেন, এমএমএস ক্যান্সার তো বটেই, করোনাভাইরাসও সারাতে পারে।

তাদের এই দাবি অবশ্য নতুন নয়। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের বহু আগে থেকেই এ ধারণা প্রচার করছেন জর্ডান স্যাথার।

virus-3.jpg

তবে তার এই দাবি অমূলক বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)। বরং ক্লোরিন মিশ্রিত ওই দ্রবণ পান করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে সতর্ক করেছে তারা।

এফডিএ জানিয়েছে, এ ধরনের দ্রবণ পান করলে বমি, ডাইরিয়া, পানিশূন্যতাসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো আরও কয়েকটি দেশ ‘মিরাকল মিনারেল সাপ্লিমেন্ট’ পানের বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে।

৪. ঘরে তৈরি হ্যান্ড স্যানিটাইজার
চীনের পর করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ইতালিতে। দেশটিতে করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় ইতোমধ্যেই হ্যান্ডস্যানিটাইজারের সংকট দেখা দিয়েছে। একারণে অনেকেই মদ-জাতীয় পানীয় দিয়ে বাড়িতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির পরামর্শ দিচ্ছেন।

virus-3.jpg

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক স্যালি ব্লুমফিল্ড জানান, তার বিশ্বাস, মদ-জাতীয় পানীয় দিয়ে বাড়িতে কার্যকর হ্যান্ডস্যানিটাইজার তৈরি সম্ভব নয়। ঘরে তৈরি এ জীবাণুনাশক দিয়ে মেঝে, থালাবাসন পরিষ্কার করা গেলেও এটি শরীরে ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ। এতে চামড়ায় জ্বালাপোড়াসহ বিভিন্ন ধরনের অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

৫. রূপামিশ্রিত দ্রবণ পান
যুক্তরাষ্ট্রের একটি টেলিভিশন শো’তে সম্প্রতি দাবি করা হয়েছে, রূপামিশ্রিত দ্রবণ বা সিলভার কোলয়েড মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যেই করোনাভাইরাস নির্মূল করতে পারে। জিম বেকার’স শো নামে ওই অনুষ্ঠানের এক অতিথি এ দাবি করেন। তবে, নভেল করোনাভাইরাসের ওপর এখনও এ পরীক্ষা চালানো হয়নি বলেও স্বীকার করেন তিনি।

virus-3.jpg

এর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যেমে এ বক্তব্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে, যারা প্রথাগত চিকিৎসায় বিশ্বাসী নন, তারাই এটি বেশি বেশি প্রচার করছেন।

সিলভার কোলয়েডের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রূপার কণা জীবাণু ধ্বংস করতে সাহায্য করে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই দ্রবণ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এমন কোনও প্রমাণ নেই। বরং এটি ব্যবহারে কিডনি নষ্ট, হৃদরোগ, শরীরের চামড়া নীল হয়ে যাওয়ার মতো অসুখে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চঝুঁকি রয়েছে।

৬. গরমে করোনা মরে
গত কয়েকদিন থেকে ‘গরমে করোনাভাইরাস বাঁচতে পারে না’ দাবি করে সামাজিক যেগাাযোগমাধ্যমে অসংখ্য পরামর্শ ঘুরে বেড়াচ্ছে। উষ্ণ পানি পান, গরম পানিতে গোসল, হেয়ারড্রায়ার দিয়ে শরীর শুকানো বা কড়া রোদে ঘোরাঘুরি করলে করোনাভাইরাস মারা যাবে বলে প্রচার করা হচ্ছে।

এগুলো ইউনিসেফের পরামর্শ দাবি করে আইসক্রিম পরিহার করার কথাও বলছেন অনেকেই। লেখাগুলো কপি-পেস্ট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন হাজার হাজার মানুষ।

তবে এগুলো ইউনিসেফের বক্তব্য নয় বলে নিশ্চিত করেছেন শার্লত্তে গর্নিৎজকা নামে সংস্থাটির এক কর্মী। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি অনলাইনে একটা ভুয়া মেসেজ ছড়াচ্ছে… ইউনিসেফের বক্তব্য হিসেবে বলা হচ্ছে, আইসক্রিমসহ অন্যান্য ঠান্ডা খাবার পরিহার এই রোগ (কোভিড-১৯) প্রতিরোধ করতে পারে। এটা অবশ্যই পুরোপুরি মিথ্যা।’

virus-3.jpg

অধ্যাপক ব্লুমফিল্ড বলেন, আমরা জানি গরমের মৌসুমে ফ্লু ভাইরাস মানবদেহের বাইরে খুব একটা টিকতে পারে না। তবে, সেটা করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর, তা এখনও জানি না।’

‘তবে, রোদে শরীর গরম করলে তা আপনাকে ভাইরাসপ্রতিরোধী করে তুলবে, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মনে রাখবেন, ভাইরাস একবার শরীরে প্রবেশ করলে এটাকে মারার আর কোনও পথ নেই। আপনার শরীরকেই তার সঙ্গে লড়তে হবে।’

বিষয়টি ব্যাখা করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ভাইরাস মারতে হলে প্রায় ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন, যা আপনার গোসলের পানির চেয়ে অনেক বেশি উষ্ণ। বিছানার চাদর বা তোয়ালে ৬০ ডিগ্রিতে ধোয়া ঠিক আছে, এতে কাপড়ের ভাইরাস মারা যাবে। কিন্তু, অত গরম পানিতে শরীর ধোয়া ভালো বুদ্ধি হবে না। তাছাড়া, গরম পানিতে গোসল বা উষ্ণ পানীয় পান করলেও শরীরের প্রৃকত তাপমাত্রাও পরিবর্তন হবে না, যতক্ষণ না আপনি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’