করোনায় শিক্ষার্থী কমছে ঢাকার স্কুল-কলেজে

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন আবু সালেহ ইউসুফ। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) দেশের সার্বিক কর্মকাণ্ডে যে আঘাত করেছে, সেই ধাক্কায় চাকরি হারিয়েছেন তিনি। সেজন্য সপরিবারে গ্রামের বাড়ি খুলনায় চলে গেছেন আবু সালেহ। এখন সেখানেই বসবাস করবেন তিনি। যাওয়ার সময় মিরপুরের মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ের ছাড়পত্র (টিসি) নিয়ে গেছেন আবু সালেহ। খুলনায় সুবিধাজনক কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবেন মেয়েকে।

তার মতো রাজধানীতে বসবাস করে আসা এমন অনেক অভিভাবক করোনার কারণে চাকরি হারিয়ে বা ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। সন্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ে গেছেন টিসি। এ কারণে রাজধানীর স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থী।

আবু সালেহ ইউসুফ জানান, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ তাদের চার সদস্যের পরিবার। ঢাকায় ১৮ বছর ধরে থাকছিলেন। তার মেয়ে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছিল। আর ছোট ছেলে হাবিবা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল নামে একটি প্রতিষ্ঠানে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে টিসি নিয়ে সপরিবারে খুলনায় চলে গেছেন তিনি।

মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, স্কুলে ৩২ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতি শুরুর পর স্কুল থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থী টিসি নিয়ে চলে গেছে। অভিভাবকের পেশা পরিবর্তন ও কর্মস্থল বদলি সংক্রান্ত কারণ দেখিয়ে তারা টিসি নিয়েছে।

 

ঢাকা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম জানান, তার কলেজের কিছু শিক্ষার্থী টিসি নিয়ে চলে গেছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকের অভিভাবকের পক্ষে পড়ালেখার ব্যয় বহন করা অসম্ভব হওয়ায় তারা কলেজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেউ টিউশনি পড়ে পড়ালেখার খরচ জোগাড় করছিল। সেই রাস্তাও বন্ধ হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী এ কলেজ থেকে টিসি নিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

তিনি বলেন, চাকরি হারিয়ে উপায় না পেয়ে অনেক অভিভাবক কলেজ থেকে তাদের সন্তানকে ছাড়িয়ে (টিসি) নিতে বাধ্য হচ্ছেন। যারা সমস্যা নিয়ে আসছেন আমরা তাদের ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছি।

মিরপুরের সিদ্ধান্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থী রাজধানী ছেড়েছেন। কেউ জানিয়ে টিসি নিচ্ছেন, আবার কেউ না জানিয়ে চলে যাচ্ছেন। বর্তমানে নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন শুরু হলেও অনেক শিক্ষার্থীকেই পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে অনলাইন ক্লাসেও অংশ নিচ্ছে না। আমরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি।

এ পরিস্থিতিতে তার প্রতিষ্ঠানের ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী চলে যাবে বলে ধারণা করছেন নজরুল ইসলাম।

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে আমাদের স্কুলের সকল শাখা বন্ধ রয়েছে। আমরা অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছি। ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে যোগ দিচ্ছে। বাকিরা অনলাইন ক্লাসে যোগ দিচ্ছে না, অনেকে টিউশন ফি দিচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কয়জন শিক্ষার্থী স্কুল থেকে চলে যাচ্ছে তার প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে।

সেন্ট যোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ রবি পিউরিফিকেশন জানান, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বেশ কয়েজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক টিসি নিয়ে গেছেন। দ্বাদশ শ্রেণির অনলাইন ক্লাস শুরু হলেও সেখানে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত হচ্ছে না। শিক্ষকরা নানাভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।

 

তিনি বলেন, বর্তমান মহামারির কারণে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু ছাত্র কমে যাবে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে কোন ক্লাসে কতজন শিক্ষার্থী কমেছে তার প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে না।

শিক্ষার্থীদের স্কুল পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের স্কুল পরিদর্শক আবুল মনসুর ভূঁইয়া  বলেন, আমরা জানতে পেরেছি করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নিম্ন মাধ্যমিক (ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণি) পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের টিসির প্রয়োজন হবে না, তবে টিসি নিলে ভালো হবে।

অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বোর্ডের অনুমতি প্রয়োজন হবে জানিয়ে আবুল মনসুর বলেন, এক্ষেত্রে ভর্তির জন্য আবেদন করলে আমরা অনুমতি দেবো। যেন স্কুলে সিট খালি থাকলে শিক্ষার্থীরা সহজেই ভর্তি হতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি শামছুদ্দিন মাসুদ বলেন, অনেকে ঢাকা ছেড়ে তাদের সন্তানদের নিয়ে গ্রামে চলে এসেছেন। গ্রামে তারা স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের অনেকে শিক্ষককে ফোন দিয়ে সন্তানদের ভর্তি করাতে চাইছেন। এতে করে গ্রামের স্কুলগুলোতে কিছুটা বাড়তি চাপ পড়বে বলে মনে হয়।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ কমিটির প্রণেতা শিক্ষাবিদ একরামুল কবির বলেন, করোনার কারণে শহর থেকে অনেক শিক্ষার্থী চলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের অনেকে ভর্তির সুযোগ পাবে, অনেকে ঝরে পড়বে। তবে বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি বলেন, যেসব শিক্ষার্থী শহর থেকে গিয়ে গ্রামে ভর্তি হবে তারা নানা প্রতিকূলতার শিকার হবে। তারা তাদের আগের পরিবেশ পাবে না, দীর্ঘদিনের চেনা সহপাঠীদের হারাবে। এতে করে তারা পড়াশোনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলবে। এসব বিবেচনায় নিয়ে শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে টিউশন ফি যতদূর সম্ভব কমাতে হবে। গ্রাম ও শহরের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বৈষম্য দূর করতে হবে। এ বৈষম্য দূর করতে গ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভালো শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি গ্রামের স্কুলগুলোতে শহরের মতো অনুকূল শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।