প্রাণঘাতী করোনা কেড়ে নিয়েছে বাবার প্রাণ। সেই মহামারি করোনাকালেই নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিতে জর্জরিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। স্বাস্থ্য বিভাগের এই টালমাটাল অবস্থায় তার দায়িত্ব পাওয়াকে অনেকেই চরম বৈরী পরিবেশে সেনাপতির দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের এই অধ্যাপককে গত বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আবু রায়হান মিঞার সই করা এক প্রজ্ঞাপনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি বিদায়ী মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের স্থলাভিষিক্ত হলেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন মহাপরিচালক পদে ডা. খুরশীদ আলমের নিয়োগের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরই মধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত জীবনে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও মেধাবী চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক খুরশীদ আলমের বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের নেতারা, চিকিৎসক, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কেউ কেউ স্বাস্থ্য বিভাগের এই ভঙ্গুর অবস্থাকে তার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারা নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেছেন! কেউবা সাহস যুগিয়েছেন।
কুমিল্লার সিনিয়র সাংবাদিক নাছির উদ্দিন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘খুরশীদ ভাই, আমাকে মিথ্যা প্রমাণ করুন। এক চরম বৈরী পরিবেশে সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পেলেন আমাদের প্রিয়জন ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম। একজন পরিচ্ছন্ন পেশাদার মানুষ খুরশীদ ভাই। তার কর্মে তিনি বরাবরই নিবেদিত প্রাণ। একজন দক্ষ চিকিৎসক তিনি, প্রশাসক হিসেবে সফল হবেন কি-না আমি অনিশ্চিত। কারণ গত দুই যুগ ধরে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির যে বলয় এই অধিদফতরে তৈরি হয়েছে তা এক ডিজির পরিবর্তনে পাল্টে যাবে এমনটা আশা করা বাতুলতা মাত্র। এছাড়া অকর্মণ্য ও অদক্ষ ব্যুরোক্রেসিতে সফল হওয়ার মসৃণ কোনো পথও খোলা নেই। এছাড়াও শুধু সেনাপতির ইচ্ছায় ও কৌশলেই এখানে যুদ্ধ হয় না। আমাদের খুরশীদ ভাই বড়জোর নিজের পকেট ভারী করতে উদ্যোগী হয়ে দুর্নীতির নতুন ধারণা পুশ করবেন না বা বীজ বপন করবেন না এটুকু বলতে পারি। কিন্তু ওপরের দুর্নীতির শিকার হয়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হবেন না এমনটা বলার সুযোগ নেই।’
সাবেক ছাত্রনেতা অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু ফেসবুকে লিখেছেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন ডিজি এ বি এম খুরশীদ আলম। তিনি কুমিল্লার মানুষ, আশা করা যায় যোগ্যতা প্রমাণ করবেন। একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও কুমিল্লার মানুষকে বানানো হলে আরও ভালো হবে।’
একনজরে খুরশীদ আলম
অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনার মাইজখার ইউনিয়নের পানিপাড়া গ্রামে হলেও তিনি নগরীর ঝাউতলা এলাকায় স্থায়ীভোবে বসবাস করছেন। তার জন্ম ১৯৬১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। অধ্যাপক খুরশীদ আলমের দাদা মৃত ছফিউল্লাহ ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তার বাবা মো. মমিনুল হক কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিচালক ছিলেন। সম্প্রতি তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি একটি হাসপাতালে মারা গেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে খুরশীদ আলম কিংশুক ও পিপুল নামে দুই ছেলে সন্তানের জনক। এদের মধ্যে কিংশুক পেশায় চিকিৎসক এবং পিপুল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন। খুরশীদ আলমের স্ত্রী ডা. ফাতেমা রহমান পিংকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। জেলার চান্দিনায় গ্রামের বাড়ি হলেও কুমিল্লা নগরীর ঝাউতলা এলাকায় কিংশুক ও পিপুল নামে বাসভবনেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস)-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস করে ১০ম বিসিএসের মাধ্যমে ১৯৮৪ সালের ২২ নভেম্বর ইন-সার্ভিস ট্রেনিংয়ের আওতায় সহকারী সার্জন হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালের ৪ অক্টোবর মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সহকারী সার্জন হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন সাব সেন্টার ও কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সহকারী সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়াও ডা. খুরশীদ আলম সহকারী সার্জন হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার, জুনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সিনিয়র কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন।
সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক হিসেবে ২০১৮ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সদস্য।
অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও রয়েছে অবাধ বিচরণ। তিনি বাংলাদেশ বেতারের একজন তালিকাভুক্ত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। এছাড়াও তিনি জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ কুমিল্লা শাখার প্রশিক্ষক ছিলেন। পরে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।