“কলাবউ”
বিপ্লব গোস্বামী
কলাবউ দুর্গাপূজার একটি অপরিহার্য অঙ্গ।যার অন্য নাম নবপত্রিকা।এই কলাবউ মহাসপ্তমীর সকালে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্থাপন করা হয়। এই কলাবউ বা নবপত্রিকা গণেশের পাশে বসানো হয়।দর্শনার্থীদের অনেকে নবপত্রিকাকে ভুল করে গণেশের বউ বলে মনে করে থাকেন কিন্তু তা নিতান্ত ভুল।আসলে কলাবউ বা নবপত্রিকা হচ্ছে মা দূর্গার অন্য এক রূপ।
কলাবউ বা নবপত্রিকা বলতে আমরা সাধারন্ত নয়টি গাছের পাতাকে বুঝে থাকি কিন্তু দুর্গাপূজায় নবপত্রিকা হচ্ছে নয়টি গাছ।আর এই নয়টি গাছ বা উদ্ভিদকে মা দূর্গার নয় রূপের কল্পিত প্রতিক হিসাবে পূজো করা হয়।এই নয়টি বিশেষ গাছ হলো কদলী বা কলা,কচু,হরিদ্রা বা হলুদ,জয়ন্তী,বিল্ব বা বেল, দাড়িম্ব বা ডালিম,অশোক,মান ও ধান। সোনাতনী ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কলাকে দেবী ব্রহ্মাণী রূপে মায়ের পূজা করা হয়।ভক্তরা বিশ্বাস করে এই রূপে দেবী পরিবেশের অশুভ শক্তি নাশ করেন।সেই সঙ্গে দেবী কালিকাকে নবপত্রিকার কচু রূপে পূজা করা হয়।যেখানে ভক্তদের বিশ্বাস এই রূপে দেবী অশুভ শক্তি বিনাশ করে শুভ শক্তি প্রতিষ্টা করেন।আর হরিদ্রা রূপে দেবী উমা,জয়ন্তী রূপে কার্তিকী,বিল্ব রূপে দেবী শিবা,দাড়িম্ব রূপে রক্তদন্তিকা,অশোক রূপে শোকরহিতা,মান রূপে চামুণ্ডা ও ধান রূপে দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।এই ভিন্ন রূপে দেবীর কাছে ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থনা করা হয়।এই নব রূপের দেবীকে এক সঙ্গে নবপত্রিকা রূপে পূজা করা হয়।
এই কলাবউ বা নবপত্রিকা তৈরি করারও রয়েছে এক বিশেষ নিয়ম বা রীতি।একটি পাতাযুক্ত ছোট কলা গাছের সঙ্গে বাকি আটটি গাছের মূল ও পাতা সহ একত্র করে সাদা অপরাজিতা গাছের লতা দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা বা কলাবউ তৈরি করা হয়।দুটি বেল দিয়ে তৈরি করা হয় মায়ের স্তন যুগল।শেষে লাল পাড় সাদা শাড়ি বা হলুদ শাড়ি পড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে নবপত্রিকাকে বউয়ের রূপ দিয়ে পূজো করা হয়।
এই কলাবউ বা নবপত্রিকা পূজার মধ্য দিয়েই শুরু হয় দূর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠান।মহাসপ্তমীর সকালে ভক্তগণ স্নান করে শুদ্ধ বসন পরিধান করে শঙ্খ,ঘন্টা,ঢাক বাজিয়ে আর মহিলারা উলু ধ্বনি দিতে দিতে স্নান করানো হয় কলাবউকে।পুরোহিত মশাই মন্ত্র পাঠ করতে করতে নিজ হাতে নদী বা পুকুরে গিয়ে নিজ হতে স্নান করান নবপত্রিকাকে।তারপর লালপাড় নতুন শাড়ি পড়িয়ে দেবী দূর্গার ডান দিকে অর্থাৎ সিদ্ধিদাতা গণেশের পাশে স্থাপন করা হয় এই কলাবউকে।এই নবপত্রিকা বা কলাবউ স্থাপনের মধ্য দিয়েই তো দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানের প্রথাগত সূচনা করা হয়ে থাকে।ঐদিন অর্থাৎ সপ্তমীর দিন কলাবউ স্থাপনের পর দর্পণের সাহায্যে মায়ের মহাস্নান করা হয়ে থাকে।পূজোর বাকী দিন গুলিতেও সপরিবারের সঙ্গে যথারীতি কলাবউয়ের পূজো করা হয়ে থাকে।
যদিও গবেষকদের মধ্যে কলাবউ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে , যদিও বা আমরা মার্কণ্ডেয় পুরাণে কলাবউয়ের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।তবুও একথা অস্বীকার করা যায় না কলাবউ কোন দেশাচার বা লোকাচার নয়।কলাবউ দূর্গাপূজার এক অপরিহার্য আংশ।একথার প্রমাণ পাওয়া যায় কৃর্তিবাস বিরচিত রামায়ণে।যেখানে রামচন্দ্র কর্তৃক কলাবউ বা নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়।যদিও কলাবউ নিয়ে একাধিক পণ্ডিতের একাধিক মত রয়েছে তবুও এই কথা সত্য যে কলাবউ স্থাপনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার প্রথাগত সূচনা করা হয় আর বিজয়াদশমীর দিন সর্বাগ্ৰে নবপত্রিকা বিসর্জন দিয়ে মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তির নিরঞ্জন করা হয়।এ থেকেই বুঝা যায় যে কলাবউ দুর্গাপূজার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।