‘০২’ আর ‘২০’র দ্বিধায়- নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান পরিচালন সংস্থা ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার আগ মুহূর্তে পাইলটের সঙ্গে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) রুমের সর্বশেষ কথোপকথন সামনে এসেছে।
সেখানে বিমানবন্দরের এটিসি থেকে ইউএসবাংলা এয়ারলাইন্সের বিধ্বস্ত উড়োজাহাজের পাইলটকে অবতরণের জন্য দুইবার দুই রকম নির্দেশনা দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
অডিও রেকর্ডের শুরুতে শোনা যায়, কন্ট্রোল রুম থেকে ইউএস বাংলার পাইলটকে বিমানবন্দরের ডানদিকের রানওয়েতে (০২) অবতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে পাইলট বলেন, ঠিক আছে স্যার।
নির্দেশনা অনুযায়ী, পাইলট উড়োজাহাজটি বিমানবন্দরের ডান দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা জানান কন্ট্রোল রুমে। কিন্তু ডানদিকে রানওয়ে খালি না থাকায় তিনি আবার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এসময় তাকে ভিন্ন বার্তা দেওয়া হয়।
পাইলট আগের অবস্থানে দুই নম্বর রানওয়ে ফ্রি করার জন্য কন্ট্রোল রুমের কাছে অনুরোধ জানান। কিন্তু তাকে আবারও ভিন্ন বার্তা দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর পাইলট বলেন, স্যার আমি আবারও অনুরোধ করছি রানওয়ে ফ্রি করুন।
এর পরপরই উড়োজাহাজটি থেকে বিকট শব্দ পাওয়া যায়। এর কিছু সময় পরে ২টা ১৮ মিনিটে উড়োজাহাজটি ত্রিভুবন বিমানবন্দরের পাশের একটি মাঠে আছড়ে পড়ে।
এদিকে নেপালের ইংরেজি দৈনিক ‘নেপালি টাইমস’ ইউটিউবে কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে পাইলটের শেষ কথোপকথনের অডিও রেকর্ড দেওয়ার পর অধিকাংশ শ্রোতাই মন্তব্য করেন, ‘কন্ট্রোল রুম থেকে ভুল বার্তা দেওয়ার কারণেই ককপিটে দ্বিধায় পড়েন পাইলট’। একজন মন্তব্য করেন, ‘০২ আর ২০ এর দ্বিধায় গেল এতোগুলো প্রাণ!’
নেপালি ইংরেজি দৈনিকটি থেকে পাওয়া পুরো কথোপকথনটি তুলে দেওয়া হলো-
প্রথমে কন্ট্রোল রুম থেকে বলা হয়, ‘বাংলাস্টার ২১১’ (ইউএস বাংলার উড়োজাহাজ) আমি আবারও বলছি, রানওয়ে ২০ তে যাবেন না। এখনকার অবস্থানেই থাকুন।
জবাবে উড়োজাহাজ থেকে বলা হয়, ঠিক আছে। আমরা ডান দিকে যাচ্ছি। আমরা রানওয়ে ০২ এর দিকে যাচ্ছি।
সেটা ভালো। কিন্তু এখনই নামবেন (ল্যান্ড) না। রানওয়ে ০২ এখনও পরিষ্কার নয়।
পাইলট: ঠিক আছে। আমরা অপেক্ষা করছি।
এরপর ‘ভিটি-৫২০’ নামে অন্য উড়োজাহাজকে নির্দেশনা দেওয়া হয় কন্ট্রোল রুম থেকে। স্থানীয় এবং ইংরেজি ভাষায় অস্পষ্ট কিছু সংকেত আসে।
এটিসি: (ইউএসবাংলাকে প্রশ্ন করা হয়) আপনি এখন নামতে পারেন। জানান, রানওয়ে ০২ নাকি ২০-এ নামবেন?
পাইলট: ২০-এ নামার কথা জানান।
এটিসি: ঠিক আছে। রানওয়ে ২০ খালি করা হচ্ছে। বাতাস ২৭০ ডিগ্রি, ৬ উত্তর।
এরপর বেশ খানিকক্ষণ উড়োজাহাজের শব্দ।
এটিসি: ২১১ আপনি কি রানওয়ের উদ্দেশে উড়ছেন?
পাইলট: নেগেটিভ স্যার।
এরপর নির্দেশনা আসে, বাংলাস্টার ২১১ আপনি ডানে ঘুরুন।
এটিসি: নিশ্চিত করুন (কিছুটা অনিশ্চিত গলার স্বর) আপনি উত্তর দিক থেকে আসছেন? ঠিক কি না?
পাইলট: ঠিক। আমরা উত্তর দিক থেকে আসছি। নামার জন্য অনুরোধ করছি।
এটিসি: ঠিক আছে। ইউএস-বাংলা ২১১, আপনারা নামুন।
পাইলট: আমি ০২ রানওয়েতে নামার অনুরোধ করছি।
এটিসি থেকে অন্য আরেকজন রানওয়ে ০২-এ ‘বাংলাস্টার ২১১’ নামার জন্য তৈরি করতে বলা হয়।
এরপর আরেকটি কন্ঠে বলা হয়, ট্রাফিকের কারণে ‘বাংলাস্টার ২১১’ কে রানওয়ে ২০ তে নামতে হবে। সেটি এখন ২০ এর অবস্থানেই আছে। আপনি বর্তমান অবস্থান ধরে রাখুন।
আরেকটি উড়োজাহাজকে নির্দেশ দেন কন্ট্রোল রুমের ওই কণ্ঠটি। ওই উড়োজাহাজটি জবাবও দেয়। (এখানে কিছুটা অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর)। এরপর আবার উড়োজাহাজের শব্দ।
এরপর নির্দেশ আসে ইউএসবাংলার প্রতি- (উত্তেজিত কণ্ঠে) বাংলাস্টার ২১১ আমি আবারও বলছি ঘুরুন। এরপর অগ্নিনির্বাপক দলের প্রতি নির্দেশ দেন কন্ট্রোল রুমের ওই কণ্ঠ।
এরপর ২টা ১৮ মিনিটে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে দেখানো হয়।
এই কথোপকথন বিষয়ে কথা হয় একজন বৈমানিকের সঙ্গে। ওই বৈমানিক জানান, বৈমানিকদের পরিভাষায় ০২ মানে ০২০ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এর অর্থ উত্তর দিক থেকে ২০ ডিগ্রি ডানদিকে। অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিকে। আর ২০ মানে দক্ষিণ-পশ্চিম।
ওই বৈমানিক আরও জানান, কাঠমান্ডুর রানওয়েটি সিঙ্গেল রানওয়ে হলেও দুই দিক থেকে অবতরণ করা যায়। বিভিন্ন মৌসুম ও বাতাসের দিক পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে উড়োজাহাজের অবতরণ।
তিনি বলেন, কাঠমান্ডু বিমানবন্দর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮-২০ হাজার ফুট উপরে। এত উপরে উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণ অনেক কষ্টকর। কারণ উড়োজাহাজ যতই উপরে ওঠে, বাতাসের ঘনত্ব ততই কমতে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে বাতাসের দিক পরিবর্তনের (প্যাটার্ন অব উইন্ড) দিকে নজর দেওয়ই কষ্টকর। সেখানে কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগে সমস্যা হলে দুর্ঘটনা ঘটা বিচিত্র কিছু নয়।
এদিকে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই নেপাল কর্তৃপক্ষ দাবি করে, চালকের ভুলের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। দেশটির বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সঞ্জিব গৌতম সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডারকে বলেন, পাইলটের ভুলেই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে।
সঞ্জিব জানান, দুপুর ২টা ২০ মিনিটে ঢাকা থেকে আসা ‘বিএস-২১১’ উড়োজাহাজটিকে রানওয়ের দক্ষিণ পাশ থেকে নামার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি কম গতি নিয়ে উত্তর দিক থেকে অবতরণ করার চেষ্টা করে। যে কারণে রানওয়ের পাশে ছিটকে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়।
নেপালে এই দুর্ঘটনায় মোট ৬৭ যাত্রীর মধ্যে অন্তত ৫০ জন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে অন্তত ২৪ জনকে। জীবিত ১৭ জনের মধ্যে ৯ জন বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছে।
ওই ফ্লাইটে সিলেটে পড়ুয়া ১৩ নেপালি মেডিকেল শিক্ষার্থী ছিলেন। ক্রুদের মধ্যে কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ ও খাজা হোসেন মারা গেছেন। পাইলট আবিদ সুলতান ও অন্য ক্রু মেম্বার কেএইচএম শফি বেঁচে আছেন।
এদিকে আনিকা পাণ্ডে নামে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে বিজনেস ইনসাইডার জানায়, নামার সময় স্বাভাবিক গতি ছিল না ইউএস বাংলার উড়োজাহাজটির।
নামতে গিয়ে শেষ মুহুর্তে গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা করে। এর পর মূহুর্তেই এটি রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে। এর আগে দুর্ঘটনার পরপরই নেপালের সিভিল এভিয়েশনের মহাপরিচালক সঞ্জীব গৌতমকে উদ্ধৃত করে কাঠমাণ্ডু পোস্ট জানায়, অবতরণের সময়ে বেশ অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায় ফ্লাইটিতে।
সেটি অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন ছিল। রানওয়ের দক্ষিণ দিকে অবতরণের অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিণ দিকের অনুমতি নিয়ে সেটি উত্তর দিকের রানওয়েতে ল্যান্ড করে। তিনি সন্দেহ করছেন, কোনো কারিগরি ত্রুটির কারণেই এমনটা ঘটেছে।
যদিও দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি। টেলিভিশনের খবরে আরও বলা হয়েছে, উড়োজাহাজটির ক্যাপ্টেন বেঁচে আছেন বলে আশা করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে, ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন আবেদ সুলতান।
ঢাকায় ইউএস-বাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, আবেদ সুলতানই ওই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিলেন। নেপাল টিভি জানাচ্ছে, পাইলটের সহকারী হিসেবে ছিলেন একজন নারী। যিনি মারা গেছেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ইউএসবাংলার দাবি, নেপালে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ কন্ট্রোল রুমের ভুল। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ জানিয়েছেন, কন্ট্রোল রুমের ভুলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না।
সোমবার (১২ মার্চ) সন্ধ্যায় রাজধানীর বারিধারায় ইউএস-বাংলার করপোরেট অফিসে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, তারা একেকবার একেক নির্দেশনা দিচ্ছিল, যে কারণে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। আমাদের পাইলট আবিদ সুলতান বিমান বাহিনীতে ছিলেন। ১৭ হাজার ঘণ্টা ফ্লাই করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) থেকে পাইলটকে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ায় টেকনিক্যাল গাফিলতি দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয় না, আমাদের পক্ষ থেকে কোনো গাফিলতি ছিল।
তিনি বলেন, উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের দেড় ঘণ্টা পর আমরা দুর্ঘটনার খবর পাই। ওই ফ্লাইটে মোট ৩২ জন বাংলাদেশি ছিলেন, নেপালের ছিলেন ৩৩ জন এবং চীন ও মালয়েশিয়ার দুই জন ছিলেন ফ্লাইটে।
এছাড়া দুইজন পাইলট, দুইজন ক্রু ও দুইজন কেবিন ক্রু ছিলেন। ফ্লাইটে প্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন ৬৫ জন এবং দুই শিশু ছিল।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, উড়োজাহাজে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। এটা দুর্ঘটনা।
তিনি বলেন, গত তিন বছরে ইউএস-বাংলা ৩৬ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করেছে কোনো ত্রুটি ছাড়া। এই ফ্লাইটটিতেও কোনো ত্রুটি ছিল না। এটি একটি দুর্ঘটনা। নেপালের সিভিল এভিয়েশন দুর্ঘটনার কারণ জানতে কাজ করছে। আর ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হয়েছে।
ইউএস-বাংলা ইতোমধ্যে একটি হটলাইন চালু করেছে। যাত্রীদের স্বজনরা প্রতিমুহূর্তের খবর পাচ্ছে।