#

করোনা এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। ২০২০ সালের মার্চ মাসে শনাক্ত হওয়ার পর প্রায় ২ বছর সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। করোনাসৃষ্ট পরিস্থিতি মহামারি ঘোষণার পর পৃথিবীর সবকটি নদিতে অনেক পানি গড়িয়েছে। এ সময় মানুষের জীবন একদিকে যেমন স্থবির হয়ে পড়েছিল, অন্যদিকে ভবিষ্যত চিন্তায় পড়ছিল তার সুদূরপ্রসারি ছাপ। শুধু পরিণত মানুষ নয়, শিশুরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই মহামারির শিকার। বৈশ্বিকভাবে এ পর্যন্ত যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে তথ্য-উপাত্ত সাজিয়ে সেটা উপস্থাপন করা যায়। বিভিন্ন সংস্থা কাজগুলো করছে।

আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর গত কয়েক দিনে বিশ্বের অনেক দেশে বিস্তার লাভ করেছে করোনার নতুন ধরন- ওমিক্রন। এর বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। এর মধ্যেই নভেম্বরের ২৯ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) তিন দিনের বিশেষ অধিবেশনে বসেছে। ডব্লিউএইচও সাধারণত মে মাসে অধিবেশনের আয়োজন করে। তবে সংস্থাটির সদস্য দেশগুলোর গৃহীত সিদ্ধান্তে একটি বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা হয়। ৭৩ বছরের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশেষ অধিবেশনে বসেছে ডব্লিউএইচও।

ওমিক্রন আসলে কী? করোনা প্রজাতির এসএআরএস (সার্স) সিওভি-২ ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত ও সংক্রমিত হলে কোভিড-১৯ রোগের বিভিন্ন রকমের উপসর্গ দেখা দেয়। জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আত্মপ্রকাশ করে। গ্রীক বর্ণমালা অনুসরণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এদের নামকরণ করেছে। এর আগে আমরা আলফা, বেটা, গামা, ডেল্টা ধরনের কথা জেনেছি। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে বিশেষ করে পেরুতে ল্যামডা ধরন শনাক্ত হয়েছে বলে জানা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে যেটা নতুন সেটা হলো- ওমিক্রন। শব্দটি গ্রীক বর্ণমালার ১৫তম বর্ণ। সম্প্রতি আফ্রিকা অঞ্চলে শনাক্ত হয় করোনার নতুন ধরন বি.১.১.৫২৯ জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাইরাসের প্রকৃতিগত পরিবর্তনের এই বিষয়টি রোগতত্ববিদ ও গবেষকদের কাছে নতুন না। একটি ভাইরাস একাধিকবার বদলাতে পারে।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও এটা দেখা যায়। এ, বি, সি, ডি এই চার ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস আছে। এরমধ্যে মুলত এ এবং বি মানুষের মধ্যে ঋতুকালীন সংক্রমণ ঘটায়। আমেরিকায় শীতকালকে তাই ফ্লু সিজনও বলা হয়। ১৯১৮-১৯১৯ এর স্প্যানিশ ফ্লু ইনফ্লুয়েঞ্জায় বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। কীভাবে একটি অণুজীব এমন মারাত্মক হতে পারে ব্যাপক গবেষণার পরেও এখনও সেটা সম্পূর্ণভাবে জানা সম্ভব হয়নি।

আমেরিকার জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০১০ থেকে ২০২০ এর মধ্যে প্রতিবছর ১২,০০০ থেকে ৫২,০০০ মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মতে বিশ্বব্যাপী এই সংখ্যা বাৎসরিক ২৯০,০০০ থেকে ৬৫০,০০০ জন। ফ্লু প্রতিরোধে আমেরিকায় ব্যাপকভাবে টিকা দেওয়া হয়। এই টিকার কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য ৪ ধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা তৈরি করা হয় এবং পূর্বপ্রস্তুতির জন্য সারাবছর ভাইরাসটিকে অনুসরণ ও পর্যবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু তারপরেও এই টিকা শতকরা ১০০ ভাগ রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয় না।

আমেরিকার স্বাস্থ্য ও জনসেবা বিভাগ ( হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস) অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা যেমন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল, ফুড অ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন ইত্যাদির সহায়তায় একটি আন্তঃবিভাগীয় গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত করেছে যেটার কাজ হলো সারস-কোভ-২ ভাইরাসের পরিবর্তিত ধরনগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দ্রুত শনাক্ত করতে পারে এবং প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

বর্তমান সময়ের বাস্তবতা এই, ওমিক্রনের আবির্ভাব আকস্মিক ও অনভিপ্রেত হলেও অভাবনীয় নয়। প্রায় ২০মাস ধরে চলমান করোনাসৃষ্ট ভয়াবহ এক পরিস্থিতি, একটা কুয়াশাময় যুদ্ধাবস্থা অতিক্রম করে পৃথিবী কেবলমাত্র স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাচ্ছিল। এখনও নিশ্চিত না, আমরা আবার সেই শুরুর অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি কিনা। এমন আশঙ্কাজনক মন্তব্যের কারণ এই যে, ওমিক্রনে পঞ্চাশের অধিক মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটেছে যার অনেকগুলোই দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে পরাজিত করতে পারে এবং খুব দ্রুত সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে পরিচিত। এ ছাড়া ওমিক্রনে কিছু অদ্ভুত পরিবর্তনও শনাক্ত হয়েছে। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের একজন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ টম পিকক এবং স্ক্রিপস রিসার্চের সংক্রামকব্যাধি গবেষক ক্রিস্টিনা এন্ডারসন প্রায় একই ভাষায় তাঁদের বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

এমতাবস্থায় বিজ্ঞানীরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। ওমিক্রন কি ডেল্টার চেয়ে বেশি সংক্রমণপ্রবণ বা দ্রুত ছড়াতে পারে? এটা কি আগের ভ্যারিয়ান্টগুলোর চেয়েও বেশি মারাত্মক অসুস্থতা ঘটাতে পারে? আগের সংক্রমণ এবং টিকা থেকে প্রাপ্ত প্রতিরোধক্ষমতাকে কি এটা দুর্বল অথবা নষ্ট করে দিতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য যে তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন সেগুলো এখনও যথেষ্ট পাওয়া যায়নি। এসব কারণে একে উদ্বেগজনক ভ্যারিয়ান্ট এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এ পর্যন্ত ওমিক্রন সম্বন্ধে আমরা যা সামান্য জানি এবং এটা যে ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে; এই দুইয়ের পার্থক্যই মানুষের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার কারণ। সুসংবাদ এই যে, আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ তথা প্রস্তুত ও সুরক্ষিত। তুলনামূলকভাবে সুলভ রোগ নির্ণয়, প্রতিশ্রুত চিকিৎসা এবং অল্প প্রচেষ্টায় বানানো সম্ভাব্য টিকা আমাদের জন্য অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। ওমিক্রনের বহিরঙ্গটি আলাদা করা গেলেও এখনো কেউ জানে না বাস্তবে মানুষের শরিরে ঢুকে ওমিক্রন কি ব্যবহার করবে।

বিশেষজ্ঞ ডা. ফাউচির মতে সেটা জানতে আরও দুই সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার গাউটেং প্রদেশে যেখানে ওমিক্রনে আক্রান্তের সংখ্যা একদিনে ৩০০ থেকে বেড়ে ৩,২২০ হয়েছিল সেটা একটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরোপুরি টিকাপ্রাপ্তের সংখ্যা ২৫ শতাংশের কম এবং এই অঞ্চলে ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। এই এলাকায় কোভিডে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির হার এখনও কম এবং যেহেতু গুরুতর অসুস্থতার উপসর্গ প্রকাশ পেতে সময় লাগে তাই ওমিক্রনের ভয়াবহতা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে সে যাই হোক না কেন, করোনা প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক ও টিকার কোনো বিকল্প নেই, অতিআবশ্যক ভ্রমণ ছাড়া ভ্রমণ না করাই বাঞ্ছনীয়।

লেখিকা: ভারতেশ্বরী হোমসের প্রাক্তন ছাত্রী, আমেরিকা প্রবাসী চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ

উত্তর দিন

Please enter your comment!
এখানে আপনার নাম লিখুন