প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারির সময়ও ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির’র প্রবৃদ্ধি ৬.৯৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত অর্থবছর রেকর্ড ২৪.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। এ বছরও আশানুরূপ রেমিটেন্স আসছে। গত বছর রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৪ দশমিক দুই-দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তিনি বলেন, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮ দশমিক ছয়-এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এ বছর রপ্তানি আয়ে বাংলাদেশ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবে, ইনশা আল্লাহ।
বুধবার (১৩ এপ্রিল) সন্ধ্যায় বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে পণ্য পরিবহণেও ভাড়া ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে আমাদের দেশেও কিছু কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা কিন্তু চুপচাপ বসে নেই। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে স্বস্তি নিয়ে আসার।
শেখ হাসিনা বলেন, চলতি পবিত্র রমজান মাসে আমরা টিসিবি’র মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে প্রায় ১ কোটি পরিবারকে কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাশ্রয়ী দামে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। রাজধানী ঢাকায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৫টি ফ্রিজার ভ্যানে করে সাশ্রয়ী দামে মাংস, ডিম এবং দুধ বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
‘এর ফলে, অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ইতোমধ্যে কমে স্বাভাবিক পর্যায়ে এসেছে। এছাড়া, সরকার আসন্ন ঈদ উপলক্ষে ১ কোটি ৩৩ হাজার ৫৪টি ভিজিএফ কার্ডের বিপরীতে ১ লাখ ৩৩০ মেট্রিক টনের বেশি চালের বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
দেশে চালসহ কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই
কিছু গণমাধ্যমের অতিরঞ্জিত খবরে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু কিছু গণমাধ্যমে এমনভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে যেন দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে।
‘আমি দৃঢ়ভাবে আপনাদের জানাতে চাই যে, দেশে চালসহ কোন পণ্যের ঘাটতি নেই। সাশ্রয়ী দামে পণ্য কেনার জন্য টিসিবি’র দোকানে মানুষ ভিড় করবে- এটাই স্বাভাবিক। এটাকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরার কী কারণ থাকতে পারে?’
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি কৃষি। আমাদের সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির ফলে চাল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদনে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চলতি বোরো মওসুমে ধানের বাম্পার ফলন আশা করা হচ্ছে।
মেগা প্রকল্প নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে – কোন ঋণ নেওয়া হয়নি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে আমরা অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছি। আর শুধু ঋণ নয়, বিদেশি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে।’
তিনি বলেন, আমরা দেশি-বিদেশি ঋণ নিচ্ছি। তবে তা যাতে বোঝা হয়ে না উঠে সে দিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। আমাদের মূল লক্ষ্য অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সম্পদ বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করা।
সরকারপ্রধান বলেন, ২০২২ এবং ২৩ হবে বাংলাদেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের এক মাইলফলক বছর। আর কয়েক মাস পরেই চালু হতে যাচ্ছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মাসেতু। এই সেতু জিডিপি’তে ১.২ শতাংশ হারে অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
‘এ বছরের শেষ নাগাদ নাগাদ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে মেট্রোরেল চালু হবে। আশা করা যায়, মেট্রোরেল রাজধানী ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।’
আগামী অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর নদীর তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম টানেল চালু বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিট আগামী বছরের শেষ নাগাদ চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। গত মাসে পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্ধারিত সময়ের আগেই উদ্বোধন করা হয়েছে। অন্যান্য মেগাপ্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত ১৩ বছরে যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে তা অর্থনীতির সামষ্টিক সূচকগুলো বিবেচনা করলেই স্পষ্ট হয়। ২০০৯ সালে জিডিপি’র আকার ছিল মাত্র ১০২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তা ৪১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় ৭০২ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২ হাজার ৫৯১ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
‘এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ভাবনা এবং দূরদৃষ্টি-সম্পন্ন অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে। গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রেখে মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ফলেই আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে।’
দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করা সরকারের দায়িত্ব মন্তব্য করে করে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা যে সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতেন তা বাস্তবায়ন করতে অবদান রাখতে পারছি বলে আমরা গর্বিত। যতদিন বেঁচে আছি, মহান রাব্বুল আলামিন আমাকে কাজ করার সামর্থ্য দেবেন, ততদিন মানুষের জন্য কাজ করে যাব; জনগণের সেবা করে যাব।
নববর্ষের শুভমুহূর্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্নাত হয়ে বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
পহেলা বৈশাখ আমাদের অনুপ্রাণিত করে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সকল সঙ্কীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পহেলা বৈশাখ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। মনের ভেতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার শক্তি যোগায়, স্বপ্ন দেখায়।
তিনি বলেন, আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি; পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।
পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আবহমানকাল ধরে বাংলার গ্রাম-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। গ্রামীণ মেলা, হালখাতা, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন ছিল বর্ষবরণের মূল অনুষঙ্গ।
‘ব্যবসায়ীরা আগের বছরের দেনা-পাওনা আদায়ের জন্য আয়োজন করতেন হালখাতা উৎসবের। গ্রামীণ পরিবারগুলো মেলা থেকে সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র কিনে রাখতেন। গৃহস্থ বাড়িতে রান্না হতো সাধ্যমত উন্নতমানের খাবারের।’
ঢাকা শহরের বিভিন্নস্থানে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের চল ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজিমপুর, ওয়ারী, ওয়াইজঘাট, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে হালখাতা উৎসব হতো, মেলা বসতো, মেলায় পণ্য বেচাকেনা, গান-বাজনা, যাত্রা-সার্কাস ইত্যাদির আয়োজন হতো। ষাটের দশকে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণ সঙ্গীত পরিবেশন শুরু হয়।
‘আজ শুধু দেশে নয়, বিশ্বের যে প্রান্তেই বাঙালি তার বসবাস গড়ে তুলেছেন, সেখানেই বাঙালির হাজার বছরের লোক-সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। বর্ষবরণসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তারা জানান দেন, তারা বাঙালি। আর এর মাধ্যমেই পৃথিবীজুড়ে তৈরি হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির সেতুবন্ধ।’
করোনাভাইরাসের কারণে বিগত দুই বছর জনসমাগম করে উন্মুক্ত স্থানে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান না করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ অনেকটাই কমেছে। তাই এবার সীমিত আকারে হলেও বহিরাঙ্গণে অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে।’
‘তবে করোনাভাইরাস একেবারে নির্মূল হয়নি। নতুন রূপে করোনাভাইরাস আবার যেকোনো সময় যেকোনো দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসব অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অবশ্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত আছি। ইতোমধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ টিকা পাওয়ার যোগ্য মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। টিকা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয় ডোজের পর এখন বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে।’
‘এই মহামারি শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মহামারিজনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য আমার সরকার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা ২৮টি প্যাকেজের মাধ্যমে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। এতে প্রায় ৬ কোটি ৭৪ লাখ মানুষ উপকৃত হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার।’
দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর
দেশবাসীকে বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে সিয়াম সাধনার পবিত্র রমজান মাসে সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে পবিত্র মাহে রমজানের মোবারকবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
এসময় তিনি গভীর শ্রদ্ধা জানান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদ এবং ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে।
প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানান সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি। স্মরণ করেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে ঘাতকদের হাতে নিহত বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ নিহত শহিদদের।
প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে আপনজন হারানোদের প্রতি সমবেদনা জানান। এ ছাড়া নিহতদের রুহের মাগফিরাত এবং আত্মার শান্তি কামনা করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এ ভূখণ্ডের হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির বাহক এদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন ধর্মে-বর্ণে বিভক্ত হলেও ঐতিহ্য ও কৃষ্টির জায়গায় সব বাঙালি এক এবং অভিন্ন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও পয়লা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন এখনও স্ব-মহিমায় টিকে আছে। সারা বছরের ক্লেদ-গ্লানি, হতাশা ভুলে এদিন সব বাঙালি নতুন আনন্দ-উদ্দীপনায় মেতে উঠেন।