এভাবে মরবে কেন ফুটফুটে শিশুটি

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

বাসার ড্রয়িং রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খেলনা নিয়ে একদিন আগেও হেসে-খেলে মেতেছিল ছোট্ট মেয়ে রাফিদা খান রাইফা। গলায় ব্যথা অনুভব করে সে হঠাৎ। গায়ে জ্বরও ছিল হালকা। দেরি না করে বৃহস্পতিবার বিকালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নগরের অভিজাত বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালে। আশা ছিল-সঠিক চিকিৎসা নিয়েই ঘরে ফিরবে সে আবার। একদিন পর ফিরল, তবে লাশ হয়ে।

অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োগের পর ব্যথায় ছটপট করতে থাকা রাইফাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন চিকিৎসক। সেই ওষুধই তাকে পাড়িয়ে দিল চিরদিনের ঘুম। ভুল চিকিৎসা ও ডাক্তারের অবহেলায় ৩০ ঘণ্টার মধ্যেই লাশ হলো আড়াই বছরের রাইফা। তার বাবা দৈনিক সমকাল চট্টগ্রাম ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার রুবেল খান।

ভুল চিকিৎসা ও ডাক্তারের অবহেলার অভিযোগে সাংবাদিক নেতাদের দাবির মুখে ম্যাক্স হাসপাতালের এক চিকিৎসক, এক নার্স ও হাসপাতাল সুপারভাইজারকে চকবাজার থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর বিএমএ চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গকে নিয়ে থানায় যান। হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন তিনি। কেন হাসপাতাল থেকে অভিযুক্ত চিকিৎসককে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে-কৈফিয়ত চান ওসির কাছে। ওসির সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেন। এক ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রামের সব হাসপাতাল বন্ধ ও সাংবাদিকদের চিকিৎসা সেবা না দেওয়ার হুমকি দিয়ে ক্ষমতা দেখাতে থাকেন। সাংবাদিকরা তখন কঠোর অবস্থান নিলে এক পর্যায়ে সুর নরম হয় তার। পরে দু’পক্ষের আলোচনার সিদ্ধান্ত অনুসারে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকীকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পাঁচ সদস্যের পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ম্যাপ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।

সাংবাদিক রুবেল খান ও তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করে বলেছেন, শিশু রাইফা গলার ব্যথা অনুভব করায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে বৃহস্পতিবার ম্যাপ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাওয়ার দুই ঘণ্টা পরও কোনো ডাক্তারের দেখা পাননি তারা। একপর্যায়ে হাসপাতালটির কেবিনে ভর্তি করানো হয় তাকে। পরে কর্তব্যরত ডাক্তার আসলে কথা বলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বিধান রায় চৌধুরীকে ডাকা হয়। কিন্তু তিনি তাৎক্ষণিক হাসপাতালে না এসে টেলিফোনে ডিউটি ডাক্তারকে চিকিৎসার পরামর্শ দেন। বৃহস্পতিবার রাতে ডা. বিধানকে ডাকা হলেও তিনি রোগী দেখতে আসেন পরদিন শুক্রবার দুপুরে। এর মধ্যে তার পরামর্শ অনুযায়ী শিশু রাইফাকে যে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে তা প্রয়োগের পর তার শরীরে প্রচণ্ড খিঁচুনিসহ মারাত্মক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিষয়টি চিকিৎসকদের বারবার জানানোর পরও ওষুধ অপরিবর্তিত রাখেন তিনি। শুক্রবার রাতে একই অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার পর খিঁচুনি এতই বেড়েছিল যে, তার দাঁত ভেঙে মুখ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টি টেলিফোনে ডাক্তারকে জানানো হলে তিনি রোগী না দেখেই সেডিল সাপোজিটর প্রয়োগ করতে বলেন। কর্তব্যরত ডাক্তার দেবাশীষও মাত্রা না দেখেই তা প্রয়োগ করতে বলেন নার্সকে। এটি দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রাইফা।

রাইফার মৃত্যুর খবর জানাজানি হলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি কলিম সারোয়ার, সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি শহীদুল আলম, যুগ্ম মহাসচিব তপন চক্রবর্তী, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নাজিমুদ্দিন শ্যামল ও সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌসসহ সাংবাদিক নেতা ও সর্বস্বরের সাংবাদিকরা ম্যাপ হাসপাতালে ছুটে যান। তাৎক্ষনিকভাবে হাসপাতালের অভিযুক্ত ডাক্তারসহ ৩ জনকে থানায় সোপর্দ করে। এ নিয়ে থানায় ওসির সঙ্গে আলোচনা করছিলেন সাংবাদিক নেতারা। তখনই হন্তদন্ত হয়ে ওসির রুমে ঢুকে অসৌজন্য ও আপত্তিকর আচরণ শুরু করেন বিএমএ চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল। থানায় চিকিৎসককে নিয়ে আসায় চট্টগ্রামে এক ঘণ্টার মধ্যে সব হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া ও সাংবাদিকদের কোনো চিকিৎসা সেবা না দেওয়ার হুমকি দিতে থাকেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ম্যাপ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত হোসেনও। পরে আলোচনা সাপেক্ষে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি ও অভিযুক্ত চিকিৎসককে দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে একমত হন তারা। এরপর আটক চিকিৎসকসহ তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

শনিবার বাদে জুম’আ হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার শরীফ মসজিদে রাইফার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি।

সাংবাদিকদের প্রতিবাদ সমাবেশ : রাইফার মৃত্যুর প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সাংবাদিকরা। শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে এ কর্মসূচি পালন করে তারা।

সমাবেশে সাংবাদিক নেতারা বলেন, চট্টগ্রামের অধিকাংশ ডাক্তার সুনামের সঙ্গে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু ডাক্তার নামের কলঙ্ক এ পেশার অবমাননা করছেন। তারা চিকিৎসার নামে বাণিজ্য করছেন। ফয়সাল ইকবালকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়া মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদেরও হুঁশিয়ার করে দেন চট্টগ্রামের সাংবাদিক নেতারা।

চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নাজিমুদ্দীন শ্যামলের সভাপতিত্বে সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌসের সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ভূঁঈয়া, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি কলিম সরোয়ার, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু জাফর সূর্য, সাবেক সভাপতি শাবান মাহমুদ, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক জাকারিয়া কাজল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি শহীদ উল আলম, যুগ্ম সম্পাদক তপন চক্রবর্তী, নির্বাহী সদস্য আসিফ সিরাজ, সিইউজের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাঈনুদ্দীন দুলাল, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি কাজী আবুল মনসুর, যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, সিইউজের অর্থ সম্পাদক কাশেম শাহ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আহমেদ কুতুব, নির্বাহী সদস্য উত্তম সেনগুপ্ত ও রাইফার বাবা সাংবাদিক রুবেল খান প্রমুখ।

সমাবেশে সংহতি জানান বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, চট্টগ্রাম টিভি ক্যামরা জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ অ্যালামনাই এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।