এক বাস তাঁকে নামিয়ে দিয়েছে রাস্তার মাঝখানে। আরেক বাস পেছন থেকে এসে তাঁকে পিষে ফেলেছে। মুহূর্তেই ৬০ বছরের বৃদ্ধা ছামিরুন আক্তার সেলিনা সড়কে মৃত্যুর হিসাবের খাতায় কেবল একটি সংখ্যায় রূপ নিয়েছেন।
ঢাকায় প্রেসক্লাবের সামনে গতকাল সকাল সোয়া ১০টায় এ ঘটনা ঘটেছে। ছামিরুন আক্তার হাইকোর্টের মাজার মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে সূত্রাপুরের বাসা থেকে বাসে করে এখানে এসেছিলেন। তাঁর ছোট বোন সালমা জানান, তাঁর বোন ছামিরুন প্রতি শুক্রবারই হাইকোর্ট মাজার মসজিদে নামাজ পড়তে আসতেন।
গত ৩ এপ্রিল ঢাকায় দুই বাসের চাপায় কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাজীবের পর বাসচাপায় পা হারান রোজিনা আক্তার। এই দুজনের মৃত্যুর পর নগর পরিবহনের অব্যবস্থাপনার বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। কিন্তু তারপরও হাত-পা হারিয়েছেন এবং গুরুতর আহত হয়েছেন রাসেল সরকার, পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, রুনি আক্তার ও আয়েশা খাতুন। কিন্তু কোনো প্রতিকার মিলছে না। গতকাল সর্বশেষ ধড়-মাথা বিচ্ছিন্ন হয়েছে বৃদ্ধা ছামিরুনের।
ছামিরুনকে চাপা দেওয়া খিলগাঁও-মোহাম্মদপুর রুটে চলাচলকারী মিডলাইন পরিবহন বাসের চালককে আটক করেছে পুলিশ। ২২ বছর বয়সী চালক তরিকুল ইসলামের বাড়ি বরিশালের করিমগঞ্জে। পুলিশকে তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে পারেননি।
গতকাল দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ট্রাকচাপায় মারা গেছেন চারজন। হিসাবে গত ৪৭৩ দিনে সারা দেশে সড়কে অন্তত ৪ হাজার ২৯৭ জন নিহত হলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঢাকায় প্রেসক্লাবের পশ্চিম গেটের সামনে একটি বাস রাস্তার মাঝখানে ছামিরুন আক্তারকে নামিয়ে দেয়। তিনি বাঁয়ে ফুটপাতের দিকে যখন যাচ্ছিলেন, তখনই পেছন থেকে মিডলাইন পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১৩-০২৯৯) তাঁকে চাপা দেয়। বাসের পেছনের চাকার নিচে পড়ে তাঁর মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কোন পরিবহনের বাস এই বৃদ্ধাকে রাস্তার মাঝখানে নামিয়ে দিয়েছে, তা কেউ জানাতে পারেননি।
ছামিরুনের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে। থাকতেন সূত্রাপুরের নাসিরউদ্দিন সরদার লেনে। কাজ করতেন ছাতার কারখানায়। ১০-১২ বছর আগে ছামিরুনের স্বামী মারা যান। ছেলে উজ্জ্বল বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। ছামিরন নিজের আয়ে চলতেন।
মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে উজ্জ্বল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এলেও গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, বাসটি আটক করে থানায় রাখা হয়েছে। চালকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চালকের লাইসেন্সের বিষয়ে তিনি বলেন, চালক দাবি করেছেন মামলার কারণে তাঁর লাইসেন্স ট্রাফিক পুলিশের কাছে রয়েছে। বিষয়টি তাঁরা খতিয়ে দেখছেন।
দুর্ঘটনার নামে খোদ রাজধানীর রাস্তায় একের পর এক মানুষ মরতে থাকলেও পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ন্যূনতম পরিবর্তন আনার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী গতকাল বলেন, বাসগুলো যাত্রী নামানোর ক্ষেত্রে কোথাও স্টপেজের ধার ধারে না। যাত্রীদের কোনোমতে নামাতে বা ওঠাতে পারলেই তাঁদের কাজ শেষ বলে মনে করেন চালকেরা। দুর্ঘটনা এ কারণেই বেড়ে যাচ্ছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজধানীতে ৬২ শতাংশ যাত্রী বাস চলা অবস্থায় ওঠানামা করতে বাধ্য হচ্ছেন। ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়াভাবে চলাচল করে।
মোজাম্মেল হক বলেন, দুর্ঘটনা হলে যে যাত্রী মারা যায় কেবল তার ক্ষতি হয় না। বাস, বাসচালক ও বাসের মালিক সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে বাসমালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা শোধরানোর চেষ্টা করে না। তাদের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে বলে চিৎকার করে। যাত্রীদের বাঁচাতে হলে এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।