সৌম্য আগেও দল জিতিয়েছেন। পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি, বিগ ফিফটি আছে। বেশ কয়েকবার জিতেছেন ম্যাচসেরার পুরষ্কার। কাজেই এই বাঁহাতি ওপেনারের সামর্থ্য প্রমাণিত। কিন্তু মোসাদ্দেক আগে কখনো দল জেতাননি। জেতানোর সম্ভাবনাও তৈরী করতে পারেননি।
এমনকি আগের ম্যাচে আয়ারল্যান্ডে বিপক্ষে কালকের চেয়ে অনেক সুবিধাজনক ও মজবুত অবস্থানে থেকেও ম্যাচ শেষ করে বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফিরতে পারেননি। আইরিশ ফাস্ট বোলার মার্ক এডারের বলে উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন মাত্র ১৪ রান করে।
কিন্তু কাল সেই মোসাদ্দেকের অন্যরুপ। একদম আস্থার প্রতিমূর্তি। যেন ‘ধনুক ভাঙ্গা পণ’ করে মাঠে নেমেছিলেন, যে করেই হোক আজ দল জিতিয়েই মাঠ ছাড়বো আমি। তাই করেছেন। হঠাৎ মোসাদ্দেকের এই রূপবদল?
এমন কি হলো যে প্রায় রাতারাতি নিজেকে পাল্টে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ফিনিশারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন? এ কৌতূহলী প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। এমন নয়, হঠাৎ আলাদীনের আশ্চর্য্য জাদুর ‘চেরাগ’ পেয়ে নিজেকে বদলে ফেলা। কিংবা গত দুই তিন মাস ইংলিশ কাউন্টি, ভারতের আইপিএলের মত বড় আসরে অংশ নিয়ে অনেক আত্মবিশ্বাস ও আস্থা অর্জন।
মাঝের সময়টায় জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচ নেইল ম্যাকেঞ্জি আর হেড কোচ স্টিভ রোডও যে তাকে নিয়ে অনেকটা সময় ধরে বিশেষ ট্রেনিং করেছেন- তাও নয়। তাহলে কিভাবে হঠাৎ আত্মবিশ্বাস-সামর্থ্যের প্রতি আস্থা এত প্রবল হলো মোসাদ্দেকের?
আমি পারবো, আমাকে পারতেই হবে- এমন দৃঢ় সংকল্প আর ইচ্ছে জাগলো কোত্থেকে? এখন চলছে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা। অনেকেই মত দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ মতামত চলছে মোসাদ্দেককে নিয়ে। তবে যারা তাকে খুব কাছ থেকে দেখেন, তার খুব কাছের- তারা জানেন এ সাফল্যের রহস্য।
আসলে এবারের প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর মত বড় দলের নেতৃত্ব দিতে গিয়েই নিজেকে বদলে ফেলেছেন মোসাদ্দেক। অনেক তারার ভিড়েও আকাশী হলুদ শিবিরকে চ্যাম্পিয়ন করতে রেখেছেন কার্যকর অবদান। আসুন দেখে নেয়া যাক এবার লিগে মোসাদ্দেকের ব্যাটিং পারফরমেন্স।
প্রথম পর্ব আর সুপার লিগ মিলে ১৬ খেলায় ১৪ বার ব্যাট করে ৪ বার নট আউট থেকে মোট সংগ্রহ ৪৮৮ রান। গড় ৪৮.০০, স্ট্রাইকরেট ৭৪.৮৪। ছয়বার পঞ্চাশের ঘরে পা রাখা মোসাদ্দেকের ফিফটি ছিলো পাঁচটি, আর সেঞ্চুরি একটি।
সেই সেঞ্চুরিতে দল জেতেনি। কিন্তু মোসাদ্দেক দেখিয়েছেন দলের বিপদে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সামর্থ আছে আমার। সাভারের বিকেএসপি মাঠে গত ১০ এপ্রিল শেখ জামালের বিপক্ষে ১৪ রানে ৪ উইকেট আর ৭৪ রানে ইনিংসের অর্ধেকটার ইতি ঘটার পর একা টেনে নিয়ে গেছেন মোসাদ্দেক। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে শতরান পূর্ণ করেই (১৩৯ বলে ১০১) সাজঘরে ফেরত এসেছেন।
সেই মোসাদ্দেক সুপার লিগে মোহামেডানের সঙ্গে শক্ত ভিতের ওপর দাড়িয়ে ৫৭ বলে ৯৪ রানের আরও এক হার না মানা ইনিংস উপহার দিয়ে দলকে ৩০০(৩০৪)’র ঘরে পৌছে সাজঘরে আসেন। এছাড়া প্রথম লিগে অন্তত দুই থেকে তিন বার দলের প্রয়োজনে মিডল অর্ডারে ছয়-সাতে নেমে শক্ত হাতে হাল ধরেন এবং দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছেও দেন।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা ছোট্ট, খুব বেশী দিন না, এইতো সাকুল্যে আড়াই বছরের একটু বেশী (৩২ মাস)। ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের সাথে অভিষেকে ১০০.০০ স্ট্রাইক রেটে ৪৫ রানের হার না মানা ইনিংস দিয়ে শুরু ওয়ানডে ক্যারিয়ার।
তার ঠিক চার ম্যাচ পর ক্রাইস্টচার্চের অনভ্যস্ত ও প্রতিকুল কন্ডিশনে ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, লকি ফার্গুসন আর জেমস নিশামের সাজানো নিউজিল্যান্ডের ফাস্ট বোলিং তোপের বিপক্ষে আট নম্বরে নেমে তিন ছক্কা ও পাঁচ বাউন্ডারিতে হাফ সেঞ্চুরি (৫০*) করে দেখিয়েছিলেন আমি পারি।
কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তারপর কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়া। পরের ১৯ ম্যাচে আর পঞ্চাশে পৌঁছতে পারেননি। এর মধ্যে তিনটিতে ব্যাটিং পাননি। আর একটি ম্যাচ গেছে বৃষ্টিতে ধুয়ে।
তার শেষ ১৫ টি ওয়ানডে ইনিংসে ছিল এমন- ৩, ১১, ২৪*, ৯, ৪১, ১০, ২*, ৭*, ১৫, ৩*, ১১*, ১, ২৬*, ১২ এবং ১৪। তবে এর মধ্যে ছয়বার নটআউটও ছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না এই ১৫ ইনিংসে একবারের জন্য ওপরে মানে তিন, চার এমনকি পাঁচ-ছয়ে ব্যাট করার সুযোগ মেলেনি।
পুরো ক্যারিয়ারে একবার শুধু চারে ব্যাট করেছিলেন , আর পাঁচবার খেলেছেন ছয় নম্বরে। ক্যারিয়ারের বড় সময় কেটেছে সাত (১২ বার) ও আট নম্বরে (৪ বার)। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এই ডাবলিনে তিন জাতি আসরে ফাইনালের আগে শেষ ম্যাচটিও খেলেছেন ছয় নম্বরে।
এবারের লিগ চলাকালিন যত বার কথা হয়েছে, প্রায় প্রতিবার মোসাদ্দেকের মুখে শোনা গিয়েছে একটি কথা, ভাই দোয়া করেন, সর্বাত্মক চেষ্ট করছি নিজেকে মেলে ধরতে। আমি কি পারি, আমার ব্যাটিং সামর্থ্য কতটা? তা উপস্থাপন করতে। আসলে যে সময়টায় নামি, তখন ওভার বা বল থাকে খুব কম। তাই তেমন কিছু করার থাকেনা। তবে সুযোগ পেলে আমিও দল জেতানোর চেষ্টা করবো।
আর গত ২৩ এপ্রিল বিকেএসপি মাঠে লিজেন্ডস অব রুপগঞ্জকে হারিয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন হবার পর মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন, ‘জাতীয় দলের সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে প্রায় ১০-১১ জন জাতীয় ক্রিকেটার আর বিশ্বকাপ স্কোয়াডের ৭ সদস্যের সাজানো আবাহনীর অধিনায়ক আমি। এটা ছিল একটা বড় চাপ, বাড়তি দায়িত্ববোধ। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এবং আমার মনে হয়, এটা আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় অর্জন, বড় অভিজ্ঞতা; যেটা আমার নিজের খেলোয়াড়ি জীবনে অনেক সাহায্য করবে।’
সত্যিই করেছে। প্রিমিয়ার লিগে যেমন জহুরুল, মিঠুন, সাব্বিরকে পিছনে ফেলে ব্যাট হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কাল ডাবলিনেও সেই মিঠুন-সাব্বিরের অনুজ্জ্বলতার মাঝেও উজ্জ্বল মোসাদ্দেক। সত্যিই এবারের লিগ, আবাহনীর অধিনায়কত্ব এবং অন্তত তিন থেকে চার ম্যাচে কঠিন চাপ ও বিপদে শক্ত হাতে হাল ধরে দল জেতানোর অভিজ্ঞতায় মোসাদ্দেকের ব্যাট যেন ‘পুড়ে পুড়ে সোনা’ হয়েছে।
কে বলে, ঢাকা লিগ অকার্যকর? কোন কাজে দেয় না? নিম্নমানের বোলিং আর বাজে উইকেটে খেলার এ পারফরম্যান্স আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোন কাজে দেয় না? এ লিগ খেলে আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে ভাল করা যায় না?
যারা এসব বলেন, তারা শুনে রাখুন, আসল কথা হলো পারফরম করা। যে কোন আসরে পারফরম করলে, রান পেলে, সেঞ্চুরি আর গন্ডায় গন্ডায় হাফসেঞ্চুরি হাঁকালে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থাটাও বেড়ে হয় দ্বিগুণ।
এবার ডাবলিনে যে দুই ইয়াং টাইগারের ব্যাট কথা বলেছে, সেই সৌম্য আর মোসাদ্দেক এবার প্রিমিয়ার লিগে ভাল খেলেছেন। তাদের ব্যাটে ছিল রানের ফলগুধারা।
টাইগারদের সাফল্যর অন্যতম রূপকার সেই সৌম্য সরকার এবার লিগের শেষ দুটি শতরান (যার একটি আবার ডাবল সেঞ্চুরি) হাঁকিয়েই সাহস ফিরে পেয়েছেন। সামর্থ্যের প্রতি আস্থাও এসেছে। জেনে বুঝে গেছেন, আমি তো আগেও পারতাম, এখন আবার পারি, পারবোও এবং পেরেছেন।
একইভাবে মোসাদ্দেকেরও নিজের সামর্থ্যের প্রতি আস্থা বেড়েছে। আর ঢাকা লিগের আরও একটি মাহাত্ম্য কানে কানে বলি শোনেন, ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট মানেই বাঁহাতি স্পিনারের ছড়াছড়ি। এমন কোন দল নেই যেখানে অন্তত দুজন লেফট আর্ম স্পিনার থাকে না বা খেলে না। মোসাদ্দেকের দল আবাহনীতেই ছিলেন নাজমুল অপু আর সাঞ্জামুল ইসলাম।
সারা বছর নেটে বেশি বেশি বাঁহাতি স্পিনারের বলে প্র্যাকটিস আর ঢাকা লিগে ২০ ওভারের বেশী ব্যাট করলে অন্তত অর্ধেকের বেশী সময় ধরে বাঁহাতি স্পিনারের বিপক্ষে খেলার অভিজ্ঞতাই কাল মোসাদ্দেককে সাহস জুগিয়েছে।
তাই তো ২২ নম্বর ওভারে ক্যরিবিয়ান বাঁহাতি স্পিনার ফ্যাবিয়ান অ্যালেনকে পেয়েই হয়ত মন খুশিতে নেচে উঠেছিল। নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছিলেন, পেয়েছি, এটাই সর্বোত্তম সুযোগ। এই বাঁহাতি স্পিন তো সারা বছর নেটে আর ম্যাচে খেলি। তার চেয়ে মেধাবী আর ভাল মানের লেফট আর্ম স্পিনারকেই খেলি। এই ফ্যাবিয়ান অ্যালেনকেই মারতে হবে।
আর বেদম মেরে তিন ছক্কা আর এক বাউন্ডারিসহ ২৫ রানেই বদলে গেছে ম্যাচের চেহারা। পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছে বাংলাদেশের হাতে। এভাবেই এক মোসাদ্দেকের দেখা মিললো কাল ডাবলিনের মালাহিডের দ্যা ভিলেজে।
ভালই হলো। কারণ বিশ্বকাপেও মাহমুদউল্লাহ বল করতে না পারলে একজন ব্যাকআপ স্পিনার লাগবে অবশ্যই। সাকিব-মিরাজের যে কারো একটি খারাপ দিন যেতেই পারে। তখন ব্যাকআপ অফস্পিনার খুব দরকার পড়বে। এই বদলে যাওয়া মোসাদ্দেকের খোলা তরবারির মত ব্যাটের পাশাপাশি বোলিংটাও বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে সার্ভিস দিতে পারবে। সে সামর্থ্যও আছে ময়মনসিংহের এ ২৩ বছর বয়সী সাহসী তরুণের।