জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনের শাস্তির রায় প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া ও তার ছেলে এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন। তাদের শাস্তি হয়েছে। লজ্জা থাকলে তারা জীবনে আর দুর্নীতি-লুটপাট করবেন না। আদালত রায় দিয়েছেন। আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু অন্যায় করলে যে শাস্তি পেতে হয়, সেটাই আজ প্রমাণ হয়েছে।’
বৃহস্পতিবার বরিশাল নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যানে বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন।
আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার কুফল বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করে তিনি আরও বলেন, তারা ক্ষমতায় থাকলে দেশকে ধ্বংস করে। জনগণের সম্পদ লুটপাট করে। লুটপাট-দুর্নীতি, সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা- এসব ছাড়া আর কিছুই তারা পারে না। তবে এ দেশে দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টিকারী আর মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকারীদের স্থান হবে না।
উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগামী নির্বাচনেও নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। গত ৯ বছরে দেশে যে উন্নয়নের ধারা সূচিত হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্যই ওই নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে হবে। কারণ একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের উন্নয়ন হয়, দেশ এগিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ মানে দেশের উন্নয়ন, মানুষের কল্যাণ ও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী জনসভায় উপস্থিত লাখো মানুষের কাছে নৌকায় ভোট দেওয়ার অঙ্গীকার চাইলে জনতা দুই হাত তুলে তার প্রতি সমর্থন জানান।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দেশ ও জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণে বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের মানুষ শান্তিতে থাকে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার রায় প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, এতিমের টাকা পর্যন্ত চুরি করেছেন। এতিমের টাকা মেরে খাওয়া আল্লাহও বরদাশত করেন না। সেই শাস্তিই খালেদা জিয়া ও তার ছেলে পেয়ে গেছেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল ও সরকার পতন আন্দোলনের নামে ২০১৩-২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও মানুষ পুড়িয়ে হত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৫ সালে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে উৎখাত না করে তিনি ঘরে ফিরবেন না। আর হুকুম দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছিলেন। ক্ষমতায় থাকতেও তারা লুটপাট-দুর্নীতি করেছেন, মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছেন। আজ তিনি কোথায়? মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করলে তার শাস্তি এমনই হয়। অত্যাচার-নির্যাতন করলে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। আর যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেন তাদের বিচারও এমনই হয়। সেই বিচারই হচ্ছে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারে সকাল ১০টায় বরিশালের বাকেরগঞ্জ সীমান্তে পায়রা নদীর তীরে পটুয়াখালীর লেবুখালীতে যান। সেখানে নবনির্মিত ‘শেখ হাসিনা সেনানিবাস’ উদ্বোধন এবং সাত পদাতিক ডিভিশনসহ ১১টি ইউনিটের পতাকা উত্তোলন, প্যারেড পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ১৪টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং গলাচিপা উপজেলা পরিষদের প্রশাসনিক ভবন সম্প্রসারণ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
বিকেলে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানের জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন তিনি। এ সময় জনতা বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ও তুমুল স্লোগানের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানান। জনসভা শুরুর আগে বঙ্গবন্ধু উদ্যান থেকে বরিশালের উন্নয়নে ৩৯টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ৩৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে বিশেষ অবদান রাখায় বরিশালের অক্সফোর্ড মিশনে কর্মরত ব্রিটেনের নাগরিক লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্টের হাতে তার ১৫ বছরের মাল্টিপল ভিসাসহ পাসপোর্ট হস্তান্তর করেন।
বরিশাল বিভাগে উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বরিশালবাসীর জন্য তিনি উপহার নিয়ে এসেছেন। ভোলায় পাওয়া গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে বরিশালে সরবরাহ ও ভোলায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্ট প্রতিষ্ঠা, বরিশালসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং ভোলার সঙ্গে বরিশালের সড়ক যোগাযোগ স্থাপন ও সেতু নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণসহ নানা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিও দেন প্রধানমন্ত্রী। জনসভায় বক্তব্য শেষে সন্ধ্যার আগেই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ফিরে যান তিনি।
বিভিন্ন দাবি জানিয়ে জনসভার সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তারা দক্ষিণাঞ্চলের জন্য কিছুই করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলে সকল গণমুখী উন্নয়ন হয়েছে। সমুদ্র বন্দর, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিক্ষা বোর্ড, লেবুখালী সেতু, দোয়ারিকা-শিকারপুর সেতুসহ সকল উন্নয়ন শেখ হাসিনা করেছেন।
জনসভায় আরও বক্তব্য রাখেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগ নেতা ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, মাহবুবউল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, শ. ম. রেজাউল করিম, আফজাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, শাম্মী আহমেদ, তালুকদার মো. ইউনূস, জেবুন্নেসা আফরোজ, একেএমএ আউয়াল, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, ফজলুল কাদের মজনু প্রমুখ।
জনসভা পরিচালনা করেন গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল ও একেএম জাহাঙ্গীর।
যেসব প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন: পটুয়াখালীর লেবুখালীতে উদ্বোধন করা প্রকল্পের উল্লেখযোগ্যগুলো হলো— পটুয়াখালী ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ডায়াবেটিক হাসপাতাল, মির্জাগঞ্জ ও বাউফল উপজেলায় ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র, কাজী আবুল কাশেম স্টেডিয়াম, দশমিনা ও কলাপাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, গলাচিপা মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি কমপ্লেক্স এবং শহীদ শেখ কামাল স্মৃতি কমপ্লেক্স মিলনায়তন।
বরিশালের জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী যেসব প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তার মধ্যে রয়েছে— বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল, শেখ হাসিনা হল, শেরেবাংলা হল ও বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর একাডেমিক ভবন, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল একাডেমিক ভবন, শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, বরিশাল বিভাগীয় ও জেলা শিল্পকলা একাডেমি, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, বাবুগঞ্জ উপজেলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, বরিশাল সদর, মেহেন্দিগঞ্জ থানা কমপ্লেক্স ভবন, আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, গৌরনদী, মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলা, মুলাদী ও বাকেরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন, বানারীপাড়া উপজেলার চৌমোহনা জিসি-বানারীপাড়া হেডকোয়ার্টার ভায়া বিশারকান্দি ওমারের পাড় রাস্তায় নান্দুহার নদীর ওপর ২০৯ মিটার আরসিসি গার্ডার ব্রিজ, উলানীয়া-কালীগঞ্জ ব্রিজ, ৩০০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণাগার, ৩১ শয্যাবিশিষ্ট মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, শহীদ আরজু মনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাততলা একাডেমিক ভবন, শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাততলা একাডেমিক ভবন, বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বরিশাল পুলিশ সুপার অফিস, মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইন্স, মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তর ভবন, শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট ও বরিশালে আইটি পার্ক স্থাপন।