সোহেল আহমেদঃ ২০০১ সালের কথা। আমাদের এস এস সি’র নির্বাচনী পরীক্ষা চলছিল। আমি, রোজিনা ও মুক্তা তিনজনই একবাড়ির পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে মুক্তা সম্পর্কে আমার মামাতো বোন। বিশেষ কারণে মামা বাড়িতেই বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকে আমরা পরস্পরের প্রতি ঈর্ষানিত্ব হয়ে পড়াশুনা করতাম। সবচেয়ে কে বেশি পড়তে পারে, এরকম তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল আমাদের মধ্যে।
মেধাবী ও ধার্মিকতায় মুক্তা ছিল অসাধারণ এক প্রতিভাবান মেয়ে। নামাজ রোজা কোরআন পাঠ করাসহ বই পড়া ছিলো তার অন্যতম বৈশিষ্ট। আমাদের তিন পরীক্ষার্থীর উদ্দেশ্য ছিল ফার্স্ট কলে এলাও হব। সারা বছর শিক্ষকদের পরিশ্রমকে সফলতায় রুপ দেব। সে জন্য আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি ছিল পর্যাপ্ত।
দিন রাত পড়াশুনা করার আপ্রাণ চেষ্টায় আমরা ক্লান্ত! আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। বাংলা ১ম ও ২য় পত্র বেশ ভালোই দিলাম। একদিনের বিরতির পর আমাদের ইংরেজি পরীক্ষার প্রস্তুতি। আগের রাতে বলতে গেলে এক প্রকার নিরঘুম রাত কাটিয়েছি। যখনই ঘুমাতে যাব মনস্থ করছি, তখনই মনে হচ্ছিল কি যেন পড়া হয়নি। তাই অনেক রাত পড়তে হল।
সেদিন সাজ সকালেই আমি আর মুক্তা পরীক্ষার দেয়ার জন্য রওয়ানা হচ্ছিলাম। গেল রাতে একসাথে পড়লেও মুক্তার জ্বর দেখা দিল। মানুসিক ভাবে বাড়তি প্রেসার হয়ত মুক্তার শরীরে এ্যাডজাষ্ট হয়নি! যে কারোণে হয়ত বেশি টেনশনেই টেস্ট পরীক্ষায় মুক্তা জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল।
বাংলা দুই পেপার পরীক্ষা শেষ করেছি মাত্র। পরীক্ষা চলাকালিন সময়ে মুক্তা বেশ অসুস্থ অনুভব করল। লিখিত পরীক্ষা শেষ করে বিরতি সময়ে মুক্তা সাহিদা, সুলতানা, তানিয়া, মেবিন, লিতুনজিরার সাথে কথা বলছিলো। হঠাৎ রোজিনাকে ডেকে পানির পিপাসার কথা বলে একগ্লাস পানি এনে দিতে বলল। রোজিনা মুক্তার অসুস্থতাকে মোটেই গুরুত্ব দিলনা। আর পানি আনতে রাজি হলনা।
আমি বিষয়টি দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করলাম। ধারনা করলাম অসুস্থতা নিয়ে মুক্তার পরীক্ষা দিতে চরম কষ্ট হচ্ছে। ওর চেহারায় বিসন্নতার ছাপ পড়ে গেছে। যাহোক, সাহিদাকে এক গ্লাস পানি আনার জন্য অনুরোধ করি। সাহিদা মুক্তার ভাল বান্ধুবী। স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে গিয়ে মামার কাছে মুক্তার অসুস্থতার কথা বললাম।
মামা আমার সহজ সরল এবং অনেকটা ধর্মভিরু। অসুখ বিসুখে ডাক্তার দেখানোয় বরাবরই তার একটা অনিহা থাকে। সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করাই তার নিয়ম। বলতেন সৃস্টিকর্তা রোগ দিবেন আবার তিনিই ভালো করে দিবেন। প্রচন্ড জ্বর ও মাথা ব্যাথায় তিনদিন ধরে কাতরাচ্ছে মুক্তা। মামা-মামি চিকিৎসার জন্য ভুরুক্ষেপ দিচ্ছেন না।
ইরেজি প্রথম পত্র পরীক্ষা। রাতে আমি পড়লেও মুক্তা তেমন পড়তে পারলনা! ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি মুক্তা আমার আগে উঠে পড়ছিল। ওর পড়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। সময়ের অভাবে আমি পড়তে পারলাম না। পরীক্ষা দেয়ার জন্য দুজনেই রওয়ানার প্রস্তুতি নিলাম। মুক্তার দেরি হচ্ছিলো। অনেকক্ষন অপেক্ষায় থাকার পরে একসাথে না এসে আমি চলে এলাম। বললাম তুই পরে আসিস, আমি যাই।
এটাই ছিলো মুক্তার সাথে আমার শেষ কথা! পরীক্ষা শুরু হয়ে আধা ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে। মুক্তাকে দেখছিনা। জানালা দিয়ে বার বার দেখছি এই বুজি এলো। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার শেষ ঘন্টার ১০ বাকি আছে বলে দিলেন স্যার। মুক্তার অনুপস্থিতি! মনটায় অস্থির লাগছিলো।
নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা শেষ না করে আমি বাড়ি ফিরতেই মামি আমাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন মুক্তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। পরীক্ষা দিতে আসার সময়ে মুক্তা চোকি থেকে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপরই হাসপাতালে। মামির কথা শুনে সাইকেল নিয়েই সোজা বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেলে চলে এলাম।
দুপুরের প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে বিশাল হাসপাতালের একটার পর একটা সিড়ি বেয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে খুজতে খুজতে আমি ক্লান্ত। কোথায় মুক্তাকে আনা হয়েছে আমিতো জানিনা! হাসপাতালের প্রধান গেটে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পর ইউসুফ আলী মামার সাথে দেখা। তিনি আমায় দেখে বললেন মুক্তার অবস্থা বেশি ভালো নয়।
ইউসুব মামা মুক্তার খালু। তার সাথে কথা বলতে বলতে মুক্তার শর্য্যা পাশে গেলাম। সরকারি হাসপাতালে গরিবের জন্য কেই নেই এটা সেদিন প্রত্যক্ষ করি। অনেক বেড খালি থাকা সত্বেও সেদিন মুক্তাকে মেঝেতেই মুক্তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আমার সেজো খালা মুক্তার পাশে বসে দোয়া পড়ছেন। খালার চোখের জ্বলে ভিজে যাচ্ছে অসুস্থ মুক্তার দেহ!
আমি কিছুক্ষন মুক্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্যালাইন চলছে। মুক্তার নাকে পাইপ ঢুকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন চিকিৎসকরা। একটু পর পর মুক্তা নড়াচড়া করছে। ডাক দিলে সারা দিচ্ছিলো না। একজন ডাক্তার এসে ইউসুব মামাকে বললেন রোগীর অবস্থা আশংকাজনক। ২৪ ঘন্টায় জ্ঞান না ফিরলে কিছুই করার থাকবে না। আল্লাহকে ডাকতে বললেন চিকিৎসক।
ডাক্তারের কথায় আমি নিস্তব্ধ! তবে ঠিক রোগের কারোণে মুক্তার এ অবস্থা হল তার নাম বলছেননা ডাক্তাররা। গভীর রাতে বাড়ি এলাম। মামি জানতে চাইলেন মুক্তার অবস্থার উন্নতি কতটুকু? তাকে (মামী) হাসপাতালে নিলাম না কেনো? মামীর কান্না বিজরীত কন্ঠ এমন হল যে, ডাক্তারদের সময় দেয়া ২৪ ঘন্টার কথা বলতে পাচ্ছিলামনা। চিকিৎসা চলছে বলে আমি ঘুমাতে গেলাম।
ডাক্তারের কথা শুনে ঘুমতো হাসপাতাল থেকেই সমাপ্ত হয়েছে। বুক ভরা কান্না চেপে রাখছিলাম মামির জন্য। মামি সারারাত ঘরের ভেতর অজানা আতংকে সন্তানের জন্য পায়চারি করছেন, দোয়া কালাম পড়ছেন। আল্লাহ রহম করো বলে বলে চিৎতার দিচ্ছেন। মামীর মধ্যেও যেন আসন্ন মহাবিপদ সংকেত উকি দিচ্ছে।
হাসপাতালে না গিয়েও একজন মা তার সন্তানের বিপদ আঁচ করতে পেরে যে আর্তনাদ করেছিলেন, সেরাতে চোখে দেখেছিলাম। এবার এস এস সি টেস্ট পরীক্ষার চিন্তা নেই। মুক্তার জীবন-মৃত্যুর পরীক্ষায় আমার সব আশা আখাঙ্খা শেষ হয়ে গেল। একটা তরতাজা জীবন্ত প্রাণ হঠাৎ করেই মৃত্যুর দুয়ারে কল্পনা করা যায়!
চলে এলাম হাসপাতালে। ডাক্তারের বেঁধে দেয়া সময়ের শেষ দিন পার হতে চলেছে। মুক্তার জ্ঞান ফিরছে না। ডাক্তার এসে বললেন, রোগীর জন্য শেষ চিকিৎসা হিসেবে ৭ টা ইনজেক্শন দিতে হবে। যার প্রতিটির মুল্য তখনকার সময়ে সারে চার হাজার টাকা। একটু আগ বাড়িয়ে বললাম ডাক্তার ব্যবস্থা করুন যতদ্রুত সম্ভব।
চট্টগ্রামে দাদার কাছে টাকার জন্য ফোন করলাম। ডাক্তারের কথায় একটু আস্বস্ত হলেও মুক্তার এ করুণ পরিনতি মানতে পারছিলামনা। অজানা আতংকে চোখের পানি রাখতে পারছিনা। নাওয়া খাওয়া সহ পৃথিবীর সব কিছু ভুলে গেছি। সামনে শুধুই এক কঠিন বাস্তবতা! দুইদিন আগেও যে বোনটাকে নিয়ে পরীক্ষার হলে গেলাম, আজ সে কিনা জীবনের পরীক্ষায় ব্যস্ত!
নিয়তির খেলায় আজ সে কোনো সারা শব্দই করছে না। স্কুলের পরীক্ষার বদলে নিজেই ওপারের যাবার পরীক্ষা দিচ্ছে।
কড়া রোদ্দুর। ইনজেকশনের ব্যবস্থা করে বাড়িতে আসি। বাড়িতে স্বজন প্রতিবেশীদের পদচারণায় তিল ধারনের জায়গা নেই। মুক্তার অসুখের খবর শুনে সবাই চলে এসছে। মাথা ব্যাথার তীব্রতা বেড়েছে। রোজিনার ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে পড়লাম। রোজিনার মা আমার কান্না শুনে মাথা টিপে দিচ্ছিল।
ততক্ষনে একটু নিদ্রায় আমি। হঠাৎ টেম্পুর আওয়াজে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম। টেম্পুর ভেতর থেকে কান্নার রোল পড়ছে। মামি সহ স্বজনদের আহাজারিতে বুজতে আর ভুল করলাম না। মুক্তার নিথর দেহ নিয়ে এসেছে। তাকিয়ে রইলাম।
সহপাঠী বোনের অকাল মৃত্যুর খবর মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ল এলাকায়। স্কুলের (পিআরসি ইনস্টিটিউশন) শিক্ষক শিক্ষার্থিসহ প্রতিবেশীদের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে গেল মুন্সি বাড়ির আকাশ। মাত্র দুইদিনের জ্বর! সন্তানের চিকিৎসায় সহজ সরল পিতামাতার সেদিনের একটু অবহেলা! অতঃপর একটা তরতাজা প্রানের চিরবিদায়,,,,,,,,,! আর আমি আজও বেঁচে আছি!