একজন বৈরাগী দাদুর প্রতি ভালোবাসা

:
: ৬ years ago

সিদ্দিকুর রহমান ॥ ছোট কিংবা বৃদ্ধ, সববয়সী মানুষের প্রতি ছিলো দাদুর ভালোবাসা।
এমনকি কর্মচারীদের সাথে ছিল সন্তানসুলভ আচরন। কাউকে কোন সময় কস্ট দিছে বলে এমন
নজিরও নেই। তাছাড়া দোকানের কোন কর্মচারী যদি রাগ করে চলেও যেতেন , তাকে আবার
বুঝিয়ে দোকানে নিয়ে আসতেন। তাইতো বৈরাগী দাদুকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ দোকানের
কর্মচারীরাও। দাদুর পূর্ননাম ইন্দ্রসা বৈরাগী হলেও বৈরাগী দাদু নামে সর্ব মহলে বেশ পরিচিত
ছিল।

বরিশালের অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী বৈরাগী দাদুর দোকানের প্রসিদ্ধ সিঙ্গারা খায়নি এমন
মানুষের সংখ্যা খুবই কম। বরিশালের অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও দাদুর দোকানের ক্রেতা
ছিলেন। পাশাপাশি তার বন্ধুসুলভ ব্যবহারে ছোটরাও ছিলো বেশ মুগ্ধ । তাইতো দাদুর মৃত্যুর
সংবাদ শুনে তার দোকানে ছুটে এসেছেন বরিশাল ৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির
কেন্দ্রিয় যুগ্ম মহাসচিব এ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর
এ্যাড. মীর জাহিদুল কবির জাহিদসহ বিভিন্ন স্তরের গনমান্য ব্যাক্তিবর্গ। এছাড়াও
শোকবিবৃতি দিয়েছেন আসন্ন সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনিত মেয়র
পদপ্রার্থী ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক
আবদুল্লাহ।

তাছাড়া কেউ কেউ আসতে না পারলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা
মুঠোফোনে দাদুর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন এবং আত্মার শান্তি কামনা করেছেন। ৪৭’র
দেশভাগের পর থেকে শুরু হওয়া দাদুর হাতে বানানো সিঙ্গারার স্বাদ আজও একই রকম। নগরীর বগুড়া
রোডস্থ মুন্সীর গ্রেজে অবস্থিত ঐ দোকানটিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সব সময় ভিড়
লেগেই থাকে। কে ছোট বা কে বড় সেটা বিষয় নয়, দোকানে কে আগে এসেছে এটাই ছিল
মূখ্য বিষয়। যে আগে আসবে, সে আগেই পাবো। এমন নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বৈরাগী
দাদু ( ইন্দ্রসা বৈরাগী )।

প্রায় ২০ বছর ধরে বৈরাগী দাদুর সাথে কাজ করা মো. মোতালেব মৃধা নামে একজন কর্মচারী
আবেগাপ্লুত কন্ঠে জানান, দাদুর স্নেহ এতটাই বেশি ছিল যে, তার দোকানেই কুড়িটি বছর
কাটিয়ে দিয়েছে। এমনকি বেশি জরুরি কাজ না থাকলে, কাজও বন্ধ দিতাম না। তাছাড়া দাদুও
আমাদের জন্য কোনদিন দোকান বন্ধ দিতেন না। শুধু বলতেন আমি দোকান বন্ধ দিলে তোরা খাবি
কি ! দাদুর এই ভালোবাসা আজো আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
তিনি আরো বলেন, দাদু চলে গেছেন, রেখে গেছেন অজস্ত্র স্মৃতিটা তার । তার এই দোকানের মান
পূর্বের মত বজায় রাখার শতভাগ চেস্টা করবেন বলে জানান তিনি।
শুধু এই মোতালেব মৃধা নন, দোকানের অন্য কর্মচারী রিয়াজ মল্লিক এবং বাপ্পি মোল্লাও তাদের
শ্রদ্ধার আশ্রয়স্থল বৈরাগী দাদুকে হারিয়ে অনেকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছেন। তারা শুধুই সবার
সাথে দাদুর রেখে যাওয়া নানা স্মৃতিচারন করছেন।
কর্মচারী রিয়াজ মল্লিক জানান, দীর্ঘ ৮ বছর যাবত এই দাদুর সাথে এই দোকানে কাজ করে
আসছেন। কখনো কোন ভুল করলে, কোন বকাঝকা না করে, শুধরে দিতেন এবং ভবিষ্যতে এরকম ভুল
যেন না হয় সেটাও সর্তক করতেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, অনেক দোকানের মালিক রয়েছে, যারা কিনা দোকানের কর্মচারীদের বেতন
দিতে গড়িমসি করে। কিন্তু বৈরাগী দাদু ছিলো তার পুরোটাই উল্টো। কাজ শেষ হওয়ার এক ঘন্টা
আগে সকলের টাকা বুঝিয়ে দিয়ে তারপরে সে বাসায় চলে যেতেন।

রিয়াজ মল্লিক আরো বলেন, সাধারন মানুষকে ভালোবাসার পাশাপাশি পাগলদেরও ভালোবাসতেন
বৈরাগী দাদু। বাবুগঞ্জের মঞ্জু নামের একজন পাগল দোকানে আসলে তার প্রতি দাদুর খরচ হতে
২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তাকে ভালো খাবার খাওয়ানো থেকে শুরু নানা বিষয়ে খরচ করতেন তিনি।
শুধু মঞ্জুই না এরকম আরো কয়েকজন পাগল প্রায়শই আসতো দাদুর কাছে। আর দাদু তাদের সাদরে
গ্রহন করতেন। এদিকে বৈরাগী দাদুর মৃত্যুতে তার অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে
শোকবার্তা দিয়েছেন এবং দাদুর আত্মার চিরশান্তি কামনা করেছেন।

লতিফা আখতার নামে একজন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, মুন্সীর গ্যারেজের বৈরাগীর সিঙ্গারা
কে কে খেয়েছেন ? আমাদের বৈরাগী দাদু আজ সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার কফিন
এখনো দোকানের সামনে রাখা আছে, জনগনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। বিকেলে মেডিকেলের
সামনের সমাধিতে সমাধিস্থ করা হবে। ঈশ্বর তার আত্মা শান্তিতে রাখুন।

কুশল ইসতিয়াক লিখেছেন, পড়াশুনার জন্য ঢাকায় থাকা হলেও প্রায় ছুটিতেই বরিশালে আসা
হতো। বরিশাল এলেই ছুটে যেতাম বৈরাগী দাদুর দোকানে। আমার সাথে দেখা হলেই বৃদ্ধ দাদু
একটা হাসি দিয়েই বলতো, ভালো আছো? বৈরাগী দাদুর দোকান, আমার কৈশোর, যৌবনের
স্মৃতি বিজড়িত জায়গা। বদলে যাক বা না যাক, জৌলুসের ভিড়ে যতই ম্রিয়মান থাকুক,
তারপরেও বৈরাগী দাদুর ভালোবাসার সিঙ্গারার কথা কখনো ভুলবো না ।
জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আতিকুল্লাহ মুনীম লিখেছেন, পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে
গেলেন বরিশালের অসংখ্য ইতিহাসের স্বাক্ষী , বরিশালের নামকরা সিঙ্গারার কারিগর ( বৈরাগীর
সিঙ্গারা ) বৈরাগী দাদু। পরোপারে ভালো থেকো দাদু।

নিলয় মিতুল লিখেছেন, বগুড়া রোড মুন্সীর গেরেজ এলাকার সবার প্রিয় মানুষ বৈরাগী দাদু আর
আমাদের মাঝে নেই। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। ভাল থাকো দাদু।
টি জে সানি লিখেছেন কখনো কল্পনাও করিনি দাদুর সাথে তোলা এটাই প্রথম ও শেষ ছবি
হবে। ওপারেতে ভালো থেকো। তোমার মত অন্যদেরও সিঙ্গারা বানিয়ে খাইয়ো।
উল্লেখ্য, ভালোবাসা ও শেষ শ্রদ্ধায় চিরনিন্দ্রায় শায়িত হয়েছেন সকলের প্রিয় বৈরাগী দাদু। গত
শুক্রবার রাত ২টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি ছেলে ও
মেয়েসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। ঐদিন বিকেলেই শেরে-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালের সামনে খ্রীষ্টান কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এদিকে বৈরাগী দাদুর আত্মার
শান্তি কামনায় নগরীর চৌমাথা গোলপুকুর পাড়ে তার বাসভবনে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। এর
আগে মঙ্গলবার অসুস্থ হয়ে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।