চকরিয়া থেকে কক্সবাজারের দিকে যে মহাসড়কটি চলে গেছে, তার থেকে আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নেই উঁচুনিচু টিলা আর পাহাড়ের জনপদ দক্ষিণগুনির নয়াপাড়া। নয়াপাড়া স্কুলের পাশেই গিয়াসউদ্দিন মৌলভীর বাড়ি। তার বাড়ির পেছন থেকেই শুরু হয়েছে টিলা আর পাহাড়ের সারি।
বৃক্ষপ্রেমী গিয়াসউদ্দিনের উৎসাহেই পাহাড়ে চড়তে হলো। তার চোখেমুখে উৎসাহ, সাফল্য ও উদ্দীপনার ছাপ। পাহাড় চূড়ায় পৌঁছার আগেই বোঝা যাচ্ছিল, সবুজের সমারোহে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। পাহাড়ের মাথায় উঠে যেদিকেই তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। পাশাপাশি তিনটি পাহাড়ে নিজের স্বপ্নের বাগান গড়েছেন ৫৯ বছরের গিয়াসউদ্দিন মৌলভী। এ সবুজের রাজত্ব শুধু অর্থের টানে গড়ে তোলেননি, বৃক্ষের প্রতি রয়েছে তার ভালোবাসার এক সবুজ গল্প। গিয়াসউদ্দিনের এ বৃক্ষপ্রেম শুধু তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করেনি, একই সঙ্গে সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও রাখছে বড় ভূমিকা।
শৈশব থেকেই সবুজের প্রতি দুর্বলতা বৃক্ষপ্রেমী গিয়াসউদ্দিনের। একসময় এ অঞ্চলে শুধু গাছ কাটা হতো। গিয়াসউদ্দিন এমন একটি পরিবেশ চাইতেন, যেখানে পাহাড় থাকবে, সবুজ থাকবে চারপাশ। পশুপাখির নিরাপদ আবাস হবে। তাদের কলকাকলিতে ভরে উঠবে প্রকৃতি। গিয়াসউদ্দিনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, বনায়ন।
গিয়াসউদ্দিন মৌলভী বলেন, ৩০ বছর আগে হাটহাজারী মাদ্রাসায় শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে মা-বাবা আর প্রকৃতির টানে বাড়িতে ফিরে আসি। শুরু করি চাষাবাদ। প্রায় দেড় যুগ আগে বিএটি
বাংলাদেশ-এর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় হলে বনায়নের ধারণা পাই। এর পরের তিন বছরে বনায়ন কর্মসূচি থেকে তিন ধাপে বিনামূল্যে ২৫ হাজার চারা পাই। নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমে গাছগুলোকে বড় করতে থাকি।
গিয়াসউদ্দিন জানান, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান তার স্ত্রী। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৪ মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে তাকে। এর মধ্যে দশ দিন ছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের আইসিইউতে। সহধর্মিণীকে বাঁচাতে না পারলেও সান্ত্বনা এইটুকু যে, চিকিৎসায় ত্রুটি রাখেননি। এর আগে বাবা-মায়ের অসুস্থতার জন্যও অনেক অর্থ খরচ হয়েছে। পরিবারের এ বাড়তি ব্যয় বহন করতে পেরেছেন শুধুমাত্র বাগান ছিল বলে। গত এক যুগে বাগানের কাঠ ও লাকড়ি বিক্রি করে ১৫ লাখ টাকার বেশি আয় করেছেন।
গিয়াসউদ্দিন জানান, বর্তমানে তার বাগানে ২০ লাখ টাকার মতো গাছ রয়েছে। যখন প্রয়োজন হয়, তখন গাছ বিক্রি করেই অর্থ জোগাড় করেন। আবার নতুন গাছ লাগান।
গিয়াসউদ্দিন জানান, প্রায় দুই-তিন দশক আগেও এ এলাকার মানুষের জীবিকার মূল মাধ্যমই ছিল বন থেকে গাছ কাটা। এখন অবস্থার বেশ পরিবর্তন হয়েছে। তবে থেমে নেই বৃক্ষনিধন। কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই তিনি বলেন, ইটভাটায় জ্বালানি লাগে এবং আসবাবপত্রের কাঠ লাগে, সেটা এ অঞ্চল থেকেই যায়। তিনি বলেন, গাছ না থাকলে পাহাড় থাকবে না, ধ্বংস হবে প্রকৃতি। তাই গাছ লাগাতে হবে। পাহাড়, প্রকৃতি বাঁচাতে গাছই সমাধান। অর্থাৎ গাছ থাকলে পাহাড় থাকবে, বাঁচবে প্রকৃতি।
গিয়াসউদ্দিনকে বনায়নের কাজে সাহায্য করেন কবির হোসেন নামে এক যুবক। তিনি বলেন, গাছের ডালপালা ছেঁটে যে লাকড়ি হয়, সেগুলো বিক্রি করে অর্থ পাওয়া যায়। তেমনি এ লাকড়ি দিয়েই পরিবারের রান্নাসহ জ্বালানির চাহিদা মেটানো হয়। যতগুলো গাছ কাটা হয়, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আবার রোপণ করা হচ্ছে।
গিয়াসউদ্দিন যে শুধু নিজেই গাছ লাগিয়েছেন, তা নয়। প্রতিবেশী ও গ্রামের অন্যদেরও উৎসাহিত করেন গাছ লাগাতে। তিনি বলেন, এই সবুজই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। এই নয়াপাড়ায় এখন প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়।