একই স্কুলে ৩ বছরের জায়গায় ৩৩ বছর চাকরি!

:
: ৭ years ago

সরকারি নিয়মে তিন বছর পর বদলির নিয়ম থাকলেও রাজধানীর ২৪ সরকারি স্কুলের ৫২২ জন শিক্ষক সর্বনিম্ন ১০ বছর থেকে ৩৩ বছর পর্যন্ত চাকরি করছেন। এসব শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানোর নামে কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছেন।

২৪টি সরকারি স্কুলের তালিকায় ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকাধীন নামিদামি গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুল, শেরে বাংলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গণভবন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ধানমন্ডি কামরুনন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ও রয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

দুদকের কর্মকর্তারা জানান, মহানগরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য ও নিয়োগ বাণিজ্যের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন আজ কমিশনে দাখিল করা হয়ে।

দুদকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০১৬ সালের শেষের দিকে দুদকের কাছে ঢাকা মহানগরীর নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য ও নিয়োগ বাণিজ্যের নামে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি হচ্ছে বলে একটি অভিযোগ আসে।

কমিশন তাৎক্ষণিকভাবে কমিশনের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে বিষয়টি তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ টিম গঠন করে। ২০১৬ সালে কমিশনের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বিভিন্ন নামি-দামি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়।

কমিশনের এই বিশেষ টিমের সদস্যরা এসকল প্রতিষ্ঠানের ভর্তি কার্যক্রমের পর্যালোচনামূলক একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন কমিশনে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে বিভিন্ন নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনোপ্রকার ভর্তি বাণিজ্য সংঘটিত হয়নি। দেশের কোনো গণমাধ্যমেও ২০১৬ সালে ভর্তি বাণিজ্যের কোনো সংবাদ কমিশনের গোচরীভূত হয়নি।

এমনকী এ বছরের ১০ মার্চ দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী মানববন্ধনে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দুুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, ২০১৬ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের পদক্ষেপের কারণেই দেশের, বিশেষ করে মহানগরীর নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি-বাণিজ্য হয়নি।

কিন্তু এই অভিযোগটি অনুসন্ধানাধীন অবস্থায় কমিশনে আসা অভিযোগে বলা হয়, বিভিন্ন সরকারি স্কুলে কতিপয় শিক্ষক সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে সরকারি নীতিমালার তোয়াক্ক না করে ২০ থেকে ২৫ বৎসর একই বিদ্যালয়ে কর্মরত থেকে প্রাইভেট পড়ানোর নামে কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করছেন।

এরপর দুদক ওই একই টিমকে দায়িত্ব দেয় বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য। আজ (বুধবার) অনুসন্ধান টিমটি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করেছেন। ওই প্রতিবেদন বলা হয়, টিমের সদস্যরা বিষয়টি অনুসন্ধানের লক্ষ্যে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। তারা পরিদর্শনকালে দেখেন অনেক শিক্ষক পাঠদানে মনোযোগী না হয়ে প্রাইভেট পড়ানোর কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকেন।

তারা অনুসন্ধান প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকাধীন গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুল, শেরে বাংলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গণভবন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ধানমন্ডি কামরুনন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়সহ ২৪টি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫২২ জন শিক্ষক রয়েছেন যারা ১০ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৩৩ বছর পর্যন্ত একই বিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। এসকল শিক্ষকদের সরকারি নীতিমালা/নির্দেশিকা অনুসারে বদলি করা হয়নি বা হচ্ছে না।

শিক্ষা প্রশাসন টিমকে জানিয়েছে, সরকারি নীতিমালা মোতাবেক একই কর্মস্থলে তিন বৎসরের অধিক সময় অতিবাহিত হলেই অন্যত্র বদলি করার নির্দেশনা রয়েছে। এই বদলি না করার মূলে রয়েছে চাপ প্রয়োগ, তদবির ও অনৈতিক আর্থিক লেন-দেন। কিছুসংখ্যক শিক্ষক কোচিং বা প্রাইভেট বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বছরের পর বছর ঢাকার একই বিদ্যালয়ে অবস্থান করছেন।

একই কর্মস্থলে বছরের পর বছর থাকার ফলে এসকল শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানোর নামে কোচিং বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন এবং এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইংরেজি শিক্ষক বা গণিত শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে ইংরেজি বা গণিতের শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে; তা সমন্বয় করা হচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে কোচিং বাণিজ্য ও সিন্ডিকেট।
এ প্রেক্ষাপটে প্রাইভেট বা কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা লক্ষ্যে বিশেষ টিমের প্রতিবেদনে কতিপয় সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ হচ্ছে- ১০ বৎসর বা এর অধিক সময় যেসকল শিক্ষক একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন তাদেরকে বিভাগের বাইরে বদলি করা। পাঁচ বছরের অধিককাল কর্মরত শিক্ষকদের ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে বদলি নিশ্চিত করা। যেসকল শিক্ষক তিন বৎসরের অধিককাল একই বিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন ওই সকল শিক্ষকদের অন্যত্র বদলি নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশের সাতজন জেলা শিক্ষা অফিসারকে জেলার দায়িত্ব না দিয়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের বদলি করে জেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে বদলি নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এ জাতীয় কর্মকর্তাদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদায়ন না করতে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কাছে গণমাধ্যমকর্মীরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি কমিশনের কর্মকর্তা পর্যায়ে জমা হয়েছে বলে শুনেছি। প্রতিবেদনটি এখনও কমিশন পর্যায়ে আসেনি। কমশনে উপস্থাপিত হলে কমিশন পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।

তিনি বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা নিয়ে কারও ছিনিমিনি করার অধিকার নেই। এক্ষেত্রে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন।

দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ঢাকায় প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে সুরম্য ভবন রয়েছে; বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে যাচ্ছে; অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ রয়েছে; আমাদের মেধাবী শিক্ষকগণ রয়েছেন; তারপরও কেন শ্রেণি কক্ষের শিক্ষা-কোচিং সেন্টারে চলে যাচ্ছে? শ্রেণি কক্ষের শিক্ষা শ্রেণি কক্ষেই নিশ্চিত কর প্রয়োজন মর্মে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন।