এই অগ্রযাত্রা আমরা অব্যাহত রাখব- শেখ হাসিনা

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং শহীদ দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আয়োজিত আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।

আমি শ্রদ্ধা জানাই মহান ভাষা আন্দোলনে সেই সব শহীদ, যাঁরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমাদের মা বলে ডাকার অধিকার দিয়ে গেছেন। শহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিকসহ আমাদের শহীদ, যাঁদের মহাত্যাগের বিনিময়ে আজকে বাংলা ভাষায় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি। আমি শ্রদ্ধা জানাই আমাদের মহান নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। যিনি বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং যাঁর আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছি, স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ পেয়েছি। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি আমাদের জাতীয় চার নেতা এবং ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনকে।

জাতির পিতা ১৯৭১ সালের বিশে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহর ১২টা ১ মিনিটে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে তিনি তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবল ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।’ জাতির পিতার এই মহামূল্যবান বক্তব্য থেকে এসে যায় যে, আমাদের ভাষা আন্দোলন আমাদের পথ দেখিয়েছিল আমাদের জাতিসত্তা প্রকাশের, সংগ্রামের এবং যখন পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রটা সৃষ্টি হয় এবং যখন ব্রিটিশরা ভারতে দুটি রাষ্ট্র তৈরি করে গেল, একটা পাকিস্তান, একটা ভারত। ঠিক সেই সময় নানা আলোচনা শুরু হয়। আর তখন থেকেই ভাষার বিষয়টা উঠে আসে।

আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ এবং আলোচকবৃন্দের কাছে আপনারা শুনেছেন যে, কীভাবে কী করে এই ভাষার জন্য অনেকেই তার লেখনীর মাধ্যমে বাংলাকে মর্যাদা দেওয়ার কথা বলে গেছেন। কিন্তু যখন ’৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে একটা সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল। সেই সাহিত্য সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হলো যে, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। তখনই কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, কয়েকজন ছাত্র মিলে মিছিল করে তখনকার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়েছিল এর প্রতিবাদ জানাতে। সেখানেও কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন, তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। এবং সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একটি সভা ডাকলেন। তমদ্দুন মজলিসসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠন মিলে সিদ্ধান্ত নিল ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের এবং ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে ১১ মার্চ ঘোষণা দেওয়া হলো। ১১ মার্চ এই ঘোষণা দিয়ে, সেই দিন ধর্মঘট ডাকা হয়। এবং তার আগে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি (বঙ্গবন্ধু) ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রলীগ নামে একটি সংগঠনও গঠন করেছিলেন। এবং সেই ছাত্রলীগকে দিয়েই কিন্তু সংগঠন, মানে ভাষা আন্দোলনের যাত্রা এবং এই ১১ মার্চ ধর্মঘট করতে গিয়ে আমাদের তখন অনেক নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হন, সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও ছিলেন। এমনকি আমাদের এখানে দীপু মনির বাবা ওদুদ সাহেবসহ আমাদের আওয়ামী লীগের অনেক নেতা প্রায় ৭০ জনের মতো তখন গ্রেফতার হন অথবা পুলিশের লাঠির বাড়িতে আহত হন। এরপর নাজিমউদ্দিন সাহেব একটা যোগাযোগ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তিনি ওয়াদা দিয়েছিলেন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটা তিনি পার্লামেন্টে তুলবেন এবং মেনে নেবেন। এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার ফলে সবাই আবার ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি পান। ১৬ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আমতলায় এখন আমাদের যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ তার যে আউটডোর এটাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর সেখানেই ছিল আমতলা এবং সেখানে একটা সভা হয়। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং সেখানে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণ দেওয়া হয়।

আর এই সংগ্রাম করতে গিয়ে বার বার কিন্তু তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, মুক্তি পেয়েছেন। কারণ সংগ্রাম পরিষদ তখন সমগ্র দেশে ছড়িয়ে যায়। এই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জনমত সৃষ্টি করা এবং সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য এবং এরই একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ফরিদপুরে গিয়েও গ্রেফতার হন, আবার মুক্তি পান। বার বার গ্রেফতার হয়েছেন, মুক্তি পেয়েছেন। পরবর্তীতে ঢাকায় তিনি ’৪৯ সালের অক্টোবরে একটি ভুখামিছিল করেন। তখন লিয়াকত আলী খান পূর্ববঙ্গে আসার কথা, সেই সময় এই আন্দোলনে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে গেলেন। তারপর অনেকে মুক্তি পেয়েছেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তি পাননি। তবে কারাগারে থেকেও তিনি যখনই কোর্টে অথবা চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসতেন তখনই ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। এই সাক্ষাৎকারের একটা পর্যায়ে, তিনি ছাত্রলীগের তখন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নইমুদ্দীন সাহেব এবং খালেক নেওয়াজ, তাঁদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন এবং ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, একুশে ফেব্রুয়ারি তখন প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট সেশন বসবে, তখন পার্লামেন্ট বসত জগন্নাথ হলের যে হলটা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল, আপনাদের মনে আছে ১৫ অক্টোবর, ওটাই ছিল মূলত তখন প্রাদেশিক পরিষদের মানে সংসদ ভবন, ওখানেই তখন বৈঠক হতো। যেহেতু ওখানে বৈঠক হবে, ছাত্রদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে সেই ধরনের নির্দেশনা দেন এবং সেই সঙ্গে সঙ্গেই একটা সংগ্রাম পরিষদ আবার গঠন করা হয় ’৫২ সালে এবং সেখানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যেন সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়, সে নির্দেশনাও তিনি দিয়েছিলেন।

কাজেই এভাবেই তিনি ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তাঁর দাবি আদায়ের জন্য অনশনে যাবেন এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি অনশন করা শুরু করেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের ন্যাপের মহিউদ্দিন সাহেব (তিনিও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের) অনশন করেন। অনশনরত অবস্থায় তাঁকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। যখন তাঁকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যায় ওই সময় স্টিমার এখানে ওয়াইজঘাট থেকে স্টিমার ছাড়ত, নারায়ণগঞ্জে স্টিমার থামত, তিনি আগেই খবর দিয়েছিলেন যে, নারায়ণগঞ্জের নেতৃবৃন্দ যেভাবে হোক ওনার সঙ্গে যেন দেখা করেন। সেখানেও তিনি বসে তাদের চিরকুট পাঠান এবং অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সেখানেও নির্দেশ দিয়ে যান যে, আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

ভাষার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে, সেই নির্দেশনাও তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন। কাজেই এভাবেই তিনি এই আন্দোলনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কারাগারে বসেও তিনি কিন্তু এই আন্দোলন সম্পর্কে সবসময় সচেতন ছিলেন।

’৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যখন মিছিল বের হয়, সেখানে গুলি চলে এবং আমাদের শহীদরা রক্ত দিয়ে এই ভাষা আন্দোলনকে একটা জায়গায় নিয়ে যান। অথচ সেই ’৪৮ সাল থেকে আন্দোলন শুরু ’৫২ সালে এসে বুকের রক্ত দিয়ে রক্তাক্ষরে ভাষার অধিকারের কথা আমাদের শহীদরা লিখে গিয়েছেন।

এরপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হয়। নির্বাচনে তখন যুক্তফ্রন্ট এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, তাঁরা সবাই মিলে যুক্তফ্রন্ট করেন। সেই যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলেও সেই সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। কারণ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে নানা রকম চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে এবং সেই সরকার বাতিল করিয়ে ৯২/ক ধারা দিয়ে সেখানে ইমারজেন্সি ডিক্লেয়ার করে, আবার সবাইকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবার গ্রেফতার হন।

এরপর ’৫৬ সালে এসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। সেখানে অনেক শর্ত মেনেই তাঁকে হতে হয়েছিল। যাই হোক, তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে পাকিস্তানের জন্য প্রথম সংবিধান রচনা করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর এর আগে পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হয়নি। এই সংবিধানে তখন উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয় এবং সেটা আপনারা শুনেছেন যে, শর্তসাপেক্ষে। সেটা আমরা জানি। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আসার পরই কিন্তু যে শাসনতন্ত্র পাকিস্তানে রচিত হয়েছিল, সেখানেই বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। আর সেই সরকার একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়, ছুটি ঘোষণা করা হয়, সরকারি ছুটি পালন করার জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে, প্রকল্প নিয়ে কাজও শুরু করে।

’৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করেন। আইয়ুব খান ছিলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান, তিনি একাধারে সেনাপ্রধান আবার সেই সঙ্গে নিজেকে রাষ্ট্রপতিও ঘোষণা দেন, ক্ষমতা দখল করেন। আবার আমাদের ভাগ্যে নেমে আসে সেই অমানিশার অন্ধকার এবং বাংলাকে আবারও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সে সময় আপনারা শুনেছেন, এর আগে আমি নিজেও বলেছি যে, বাংলা ভাষার চর্চা করা যাবে না, বাংলায় কথা বলা যাবে না। আবার কবিতাগুলোও, আপনারা কিছুক্ষণ আগেই শুনলেন যে, কবিতাগুলোকেও কি মুসলমানি ভাষা দিতে হবে; ‘মানে সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।’ সেটাকে করা হয়েছিল, ‘ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি, সারা দিন আমি যেন আচ্ছা হয়ে চলি।’ এমনকি কবি নজরুলের সেই কবিতা, ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’, এই মহাশ্মশান থাকতে পারবে না, সেখানে বসানো হলো গোরস্থান। আর রবীন্দ্রনাথ পড়া যাবে না, রবীন্দ্রনাথ বন্ধ করে দেওয়া হলো। রবীন্দ্রসংগীত শোনা যাবে না, রবীন্দ্রনাথ পড়া যাবে না। আমার মনে আছে, আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা, রফিক স্যার এখানে উপস্থিত আছেন, তখন কিন্তু সব শিক্ষক এর প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই সময়, আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের যিনি হেড ছিলেন হাই স্যার, তাঁকে ডেকে নিয়ে মোনায়েম খান, মোনায়েম খান খুব বিরক্ত, কারণ এখানে আন্দোলন কেন চলবে? রবীন্দ্রনাথ তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাতে কী আছে? রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কি চলে না ভাষা? কাজেই সেই দিন থেকে নজরুলের কবিতাকে মুসলমানি শব্দ দেওয়া হচ্ছে, আর রবীন্দ্রনাথ একেবারে বাতিল। এই হলো তাদের মানসিকতা। তো সেখানে দেখা গেল যে যখন হাই স্যারকে ডেকে মোনায়েম খান সাহেব বললেন যে, ‘কী মিয়ারা! আপনারা বসে খালি রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত করেন দু-চারখান রবীন্দ্রসংগীত নিজে লিখে ফেলতে পারেন না?’ উনি (হাই সাহেব) খুব ভদ্রলোক ছিলেন, খুবই নেহায়েত ভদ্রমানুষ। আমি যখন ভর্তি হই, তখন উনি বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। উনি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন যে, ‘স্যার! আমরা তো লিখতে পারি কিন্তু সেটা তো রবীন্দ্রসংগীত হবে না, আমি লিখলে ওটা তো হাইসংগীত হয়ে যাবে।’ এইভাবে আমাদের ভাষার ওপর বার বার আঘাত এসেছে।

এই আঘাতটা কিন্তু সেই আমাদের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত, বার বারই আমরা দেখেছি। কখনো রোমান হরফে বাংলা লিখতে হবে, কখনো আরবি হরফে বাংলা লিখতে হবে। এভাবে বার বার এক-একটা সমন জারি হয়েছে আর আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু সবসময় আন্দোলন করেই গেছে এর বিরুদ্ধে। কারণ প্রত্যেকটা অর্জনই কিন্তু সংগ্রাম করে, আন্দোলন করে আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। প্রত্যেকটা অর্জনের পেছনে আমাদের কিন্তু অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা রয়েছে। জাতির পিতা যে কথাটা বলেছিলেন যে, আমাদের ভাষা আন্দোলন এটা শুধু যে ভাষার জন্যই তা নয়; এখানে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ আন্দোলন ছিল। এই ধারাবাহিকতায় কিন্তু জাতির পিতা একটা জাতিকে ধীরে ধীরে আন্দোলনের পথ বেয়ে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি যে ছয় দফা দিয়েছিলেন, সেই ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সোপান। এটা পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছিল, যে কারণে ছয় দফা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে ফাঁসি দিয়ে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু এখানে আমাদের ছাত্রসমাজ, দেশের জনগণ ব্যাপক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটিয়েছিল এবং বাধ্য করেছিল এই মামলা প্রত্যাহার করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে। মুক্তিটা তখন তিনি পেয়েছিলেন ’৬৯ সালের বাইশে ফেব্রুয়ারি।

আমি জানি না, উনার জীবনীটা পড়লে খুব অদ্ভুত লাগে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের যে সংগ্রাম তিনি ’৪৮ সালে শুরু করলেন এবং একের পর এক গ্রেফতার হলেন। এর পরে যখন ’৪৯ সালে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন তারপর কিন্তু আর মুক্তি পাননি। ’৪৯, ’৫০, ’৫১; এরপর ’৫২ সালে গিয়ে সাতাশে ফেব্রুয়ারি যখন তিনি অনশনরত অবস্থায় প্রায় মৃতপ্রায়, তখন তিনি সাতাশে ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান।

আবার ’৬৯ সালে যখন তাকে গ্রেফতার করা হলো, তারপর তিনি মুক্তি পেলেন বাইশে ফেব্রুয়ারি ’৬৯ সালে। ’৬৬ সালে গ্রেফতার করা হয়, ’৬৬ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল, তাঁর বিরুদ্ধে অনেক মামলা দেওয়া হলো এবং অনেক সাজাও দেওয়া হলো। তারপর ’৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রয় কারাগার থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো। ১৮ জানুয়ারি যখন নিয়ে যাওয়া হয়, আমরা পরিবারের কেউ জানি না কোথায় নিয়ে গেছে, কেমন আছেন, বেঁচে আছেন কিনা। কোনো খবরই আমরা পাইনি। যখন আগরতলা মামলা শুরু হয়, ওই কোর্টে প্রথম দেখা। কাজেই, এভাবে বার বার যে আঘাত এসেছে, তার পরও তিনি কিন্তু একটা নীতি নিয়ে, আদর্শ নিয়ে, বাঙালি জাতির স্বাধিকার আদায়, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। আর সেই সংগ্রামের পথ বেয়েই আজকে আমরা এই বাংলাদেশে, স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি।

তাঁর যে ঐতিহাসিক ভাষণ ৭ মার্চের, যে ভাষণ আজকে বিশ্ব-ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে, সেটা বাঙালি জাতি আজকে মর্যাদা পেয়েছে। বাঙালি জাতির জন্য এটা গৌরবের। কাজেই যা কিছু অর্জন আমাদের করতে হয়েছে, সংগ্রামের পথ বেয়েই করতে হয়েছে।

স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি দিলেন সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো। যা হোক, তারপর তিনি মুক্তি পেলেন, আমরা বিজয় অর্জন করলাম ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এর পরে জাতির পিতা মুক্তি পেলেন ৮ জানুয়ারি ’৭২ সালে, ১০ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশে ফিরে এলেন। তো ফিরে এসে যে কাজটি তিনি করেছেন যে, একটা প্রদেশ ছিল তাকে একটা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং স্বাধীনতার সুফল যেন বাংলাদেশের মানুষের ঘরে পৌঁছায় এবং একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলা, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় তিনি হাতে নিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেলেন, এই সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে নিয়ে যাওয়া। এবং ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে, একদম মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা তিনি নিয়েছিলেন; যাতে অর্থনৈতিক উন্নতিটা দ্রুত হয় এবং বাঙালি জাতি যেন বিশ্বসভায় একটা মর্যাদার আসন পায়। ঠিক যখন এই অর্থনীতি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্ষমতার আওতায় চলে এসেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চলতে শুরু করেছে, দেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের, দেশের মানুষের ভিতরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে এবং ওই যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠে যখন অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ এটা খুব কঠিন একটা কাজ ছিল, সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটি ছিল শরণার্থী। ৩ কোটি মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস ও যুদ্ধাপরাধী, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ছিল, তারা পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে গেছে। এই বাংলাদেশে তারা পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল, তারা মানুষ চায়নি তারা খালি মাটি চেয়েছিল। এইভাবে তারা গণহত্যা চালিয়েছে, আগুন দিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়েছে। ৩ কোটির ওপর মানুষ গৃহহারা ছিল, তার ওপর প্রতিটি শহীদ পরিবার, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং আমার লাঞ্ছিত মা-বোন; তাদের পুনর্বাসন, চিকিৎসা সব ব্যবস্থায় কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি (বঙ্গবন্ধু) করেছিলেন।

সব থেকে বড় কথা, মিত্রশক্তি ভারতের সেনাবাহিনী যারা আমাদের সঙ্গে ছিল, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, অনেক রক্ত ঝরেছে, কিন্তু সেই মিত্রশক্তিকেও ফেরত পাঠিয়েছিলেন। জাতির পিতার অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধী তাদের ফেরত নিয়ে যান। আমরা দেখেছি যখন বাংলাদেশ একটু অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী তখন কিন্তু ’৭৫ সালে আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগ পর্যন্ত অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য যে, ঠিক তখনই আঘাতটা এলো, জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং গোটা পরিবারকে একই সঙ্গে তিনটা বাড়ি আমার মেজ ফুফু, সেজ ফুফু, ছোট ফুফু প্রত্যেকের বাড়িতে আক্রমণ করল, প্রতিটি বাড়ির সদস্যকে হত্যা করল এবং এরপর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করল। তারপর আপনারা ধীরে ধীরে নিজেরাই শুনেছেন, প্রত্যেকটা জিনিসের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন হয়ে গেল। ঠিক পাকিস্তানি ভাবধারায় আবার এই নামগুলো পরিবর্তন করে এবং ’৭৫-এর ১৫  আগস্টের পর প্রথম যে ঘোষণা, সেখানে কিন্তু বাংলাদেশকে ওই ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে একপর্যায়ে ঘোষণা দিয়েছিল। তারপর যখন বুঝল যে, এটা মানুষ গ্রহণ করবে না, তখন আর ও কথা দ্বিতীয় বার উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু প্রথম ঘোষণাটা ওভাবে এসেছিল অর্থাৎ এটাকে যেন পাকিস্তানের একটা প্রদেশ বানাবারই একটা প্রচেষ্টা হয়েছিল।

এরপর ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি এবং যারা এসেছিল তারা তো অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী। তারা ওই আইয়ুব খানের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ক্ষমতায় এসেছে এবং দেশকে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, বাংলাদেশ যে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন করেছে, সেই বিজয়ী মনোভাবটাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া এবং পরাজিত যেই শক্তিকে আমরা পরাজিত বললাম, ওই তাদেরই প্রতি খোশামোদি, তোষামোদী, চাটুকারিতা আমরা দেখেছি। তাদের দেখলেই যেন বেহুঁশ হয়ে পড়ার মতোন অবস্থা ছিল, যারা ক্ষমতায় ছিল। যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জাতির পিতা শুরু করেছিলেন, সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মার্শাল অর্ডিন্যান্স দিয়ে বন্ধ করে তাদের মুক্ত করে তাদের দল করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল।

অনেকেই যখন বলেন যে, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছিলেন। তাদের বহুদলীয় গণতন্ত্র মানেই তো ওই যুদ্ধাপরাধীদের দল করার সুযোগ করে দেওয়া, যাদের সাজা হয়েছিল তাদের মুক্ত করা। কাউকে প্রধানমন্ত্রী, কাউকে মন্ত্রী, কাউকে উপদেষ্টা, তাদের হাতে আমার লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তুলে দেওয়া। জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার না করে পুরস্কৃৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া। কি দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বা দূতাবাসে কর্মরত তাদের পরিচয় কী? তাদের পরিচয় হচ্ছে, যার নেতৃত্বে এই স্বাধীনতা সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকারী, খুনি। আমার মনে আছে, পোল্যান্ডে যখন পাঠানো হয় একজন খুনিকে, পোল্যান্ড সরকার তাকে গ্রহণ করেনি। বলেছিল শেখ মুজিবের হত্যাকারীকে আমরা এখানে কোনো পদে আসতে দেব না। কাজেই, আমরা দেখেছি যে কীভাবে দেশের ভাবমূর্তি সারা বিশ্বে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছিল।

২১ বছর পর আমরা সরকারে আসি। আমরা আসার পর প্রচেষ্টা চালিয়েছি দেশের উন্নয়নে এবং আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সেই প্রস্তাবটা যখন করা হয়েছিল, আপনারা শুনেছেন যে, সালাম আর রফিক, তারাই আরও কয়েকটি দল— দেশের প্রতিনিধি মিলে ওই যে ভালোবাসি মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা যখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাব নিই এবং সেখানে ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোয় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। আজকে আমরা যখন ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, পৃথিবীর বহু দেশের বহু জাতির মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। কাজেই সেই মাতৃভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করা, সেই মাতৃভাষাগুলোর চর্চা করা, মাতৃভাষাগুলোর নমুনা রাখা এবং একটা ভাষা জাদুঘর, আমরা কিন্তু সেই জাদুঘর তৈরি করেছি। এই প্রতিষ্ঠানটা আমি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গিয়েছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, বিএনপি ক্ষমতায় এসে আমার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আর তারা তৈরি হতে দেয়নি, সেখানেই বন্ধ করে রেখেছিল। আমি ২০০৯ সালে সরকারে আসার পর আবার সেটা প্রতিষ্ঠা করি। কাজেই একদিক দিয়ে বোধহয় ভালো, কারণ আমি এসে আমার হাতে শুরু ছিল, আবার আমরা এসেই সেটাকেই প্রতিষ্ঠা করেছি। আজকে সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন মাতৃভাষা আমরা সংগ্রহ করছি, সেখানে গবেষণার সুযোগ আছে এবং হারিয়ে যাওয়া ভাষাগুলোকেও আমরা এখানে সংরক্ষণ করছি। ভাষা জাদুঘর একটা আমরা তৈরি করে দিয়েছি। মনে হয়, বাংলা বিশ্বব্যাপী আজকে বাংলাদেশিরই আজকে দায়িত্ব পড়েছে মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ করার।

মাতৃভাষায় শিক্ষা আমি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কাছে জানলাম যে, আমরা সাবসিডিয়ারি হিসেবে একটা মূল সাবজেক্ট আমরা নিই অথবা অনার্স আমরা নিতাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দুটি বিষয় আমরা সাবসিডিয়ারি নিই। আমি বিষয়টি জানতাম না যে, বাংলাকে আমরা যখন অনার্স করতাম তখন বলত সাবসিডিয়ারি এখন বলে মেজর অর মাইনর। কিন্তু বাংলা ভাষা নাকি শেখা যায় না, নেওয়া যায় না। এটা আমি জানি না, আমার মনে হয়, এ বিষয়ে ইউজিসির সঙ্গে বা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে যে, এটা কেন? বাংলা ভাষার প্রতি এই অবহেলা কেন?

আর আমরা ব্যাপকহারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছি, কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শিক্ষা হবে না, বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে না, এটা তো হতে পারে না। এটা কেন হবে?  আরেকটি বিষয় খুব সঠিকভাবে বলে যাই, মাত্র কিছুদিন আগে আমাকে একজন একটা বিয়ের কার্ড দিলেন, বিয়ের কার্ডটা পড়ে আমি খুব খুশি হলাম এবং তাকে ধন্যবাদও জানালাম। তিনি আমাদের সচিব ছিলেন। আমি ধন্যবাদ জানালাম এজন্য যে, তার বিয়ের কার্ডটা বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন এবং সেটা এনে দিয়েছেন। নইলে এটা ঠিকই, আমাদের স্যার যে কথা বলেছেন বা সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সাহেব যা বলেছেন এ কথা সত্যি, প্রত্যেকটা বিয়ের কার্ড হয় ইংরেজি ভাষায়। আমি ঠিক জানি না কেন হয়? অনেকে যখন নিয়ে আসত আমি জিজ্ঞেস করতাম যে, ইংরেজি ভাষায় কেন? কীসের জন্য এই দাওয়াতের কার্ড বা বিয়ের কার্ড কেন ইংরেজি ভাষায় লিখতে হবে? এটার সাথে আমি ঠিক জানি না, কোন মর্যাদার কোন বিষয় আছে কিনা, সেটাও আমি বুঝি না!  কিন্তু ইংরেজি ভাষায় লেখে। এটা কিন্তু ব্যাপকভাবে মনে হয় যেন এটা একটা ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। হ্যাঁ, যদি কোনো ইংরেজি ভাষাভাষীর জন্য তৈরি করত তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমরা বাংলা ভাষায় লিখব না কেন? দাওয়াতের কার্ডটা লিখতে পারি না কেন? এই দৈন্য কেন দেখাতে হবে? এটা আমি বুঝি না।

আজকে আমার শ্রদ্ধেয় স্যার রফিক সাহেব এবং শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সাহেব যে কথাগুলো বলেছেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো, তারা বলে গেছেন। আমরা চেষ্টা করব যে, এ কথাগুলো আমি নোট করে নিয়েছি যে, এগুলো কীভাবে সুরাহা করা যায়, তার কিছু কিছু আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব, আমাদের নিতে হবে।

অন্য ভাষা শেখার বিপক্ষে কিন্তু আমরা নই, ভাষা শিখতে হবে। আজকে সারা বিশ্বটা যেহেতু প্রযুক্তির প্রভাবে এক হয়ে গেছে, সেজন্য বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে গেলে আমাকেও অন্য ভাষা শিখতেই হবে। কিন্তু অন্য ভাষা না শিখতে পারলে আমরা উন্নত হতে পারব না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ জাপানিরা কিন্তু জাপানিজ ভাষায় কথা বলে বলে তারা সারা বিশ্বে একসময় সব থেকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছিল, তারা কিন্তু সবসময় নিজের ভাষায় কথা বলত। এখনো কিন্তু জাপানিজ ভাষাই তারা ব্যবহার করে। তবে ভাষা শেখার ব্যাপারে আমি একেবারে বিরুদ্ধে নই, যে যত বেশি ভাষা শিখতে পারবে, অবশ্যই আমরা চাই। আমি এটাই চাইব যে, আমাদের দেশে যেমন ইংরেজি এখন একটা আন্তর্জাতিক ভাষার মাধ্যম হয়ে গেছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই ইংরেজি ভাষাটা শিখছে, আগে যারা শিখত না তারাও শিখছে, তারাও কিন্তু এ ভাষার চর্চা করছে। এ ভাষায় কথা বলছে। হ্যাঁ, সেটা আমরা জানব। যখন আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথা বলতে হবে, আমরা বললাম। খুব ভালো কথা, কিন্তু আমার নিজের দেশে ভাষার জন্য, আমাদের ভাষাশহীদদের রক্ত দিয়ে, রক্তের অক্ষরে মাতৃভাষার মর্যাদা দিয়ে গেছে, আমরা সেটা শিখব না কেন? আমরা সেটা বলব না কেন? বা আমরা সেটার চর্চা করব না কেন? সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন? সেটাই হচ্ছে মূল কথা? কাজেই, আমাদের এ বিষয়টা দেখতে হবে, এই মর্যাদাটা আমাদের দিতে হবে, শুধু দিবসটা এলো পালন করলাম, তা নয়। উনারা ঠিকই বলেছেন, সাইনবোর্ডগুলো লেখা হয় ইংরেজি ভাষায়। বাংলা ভাষায় কিন্তু অনেক বিদেশি ভাষা আছে, অনেক শব্দ আছে আমরা কিন্তু শব্দগুলো গ্রহণ করে নিচ্ছি, আবার বাংলা ভাষার শব্দও অন্য ভাষায় চলে গেছে, এটাও ঠিক। এটা যায়, এটা ভাষারই একটা নিয়ম, এই আদান-প্রদান হয়। কিন্তু তার পরও আমাদের দেশে অন্য ভাষায় কেউ দিতে চাইলে দিক, কিন্তু সেখানে মাতৃভাষা বড় করে লিখবে, অন্য ভাষাটা একটু ছোট করে আলাদাভাবে লিখুক, আমাদের আপত্তি নেই। মাতৃভাষার চর্চা তো থাকতে হবে, এটা তো একান্তভাবে অপরিহার্য বলেই আমরা মনে করি। যেমন কথা হচ্ছে উচ্চ আদালতের রায়, হ্যাঁ, উচ্চ আদালতের যখন রায় হয় তখন ইংরেজিতে লেখা হয়। আমাদের চেয়ে অনেক সাধারণ মানুষ আছে হয়তো ইংরেজি ভালো জানে না, তার যে উকিল সাহেব থাকে ওই রায় পরে উকিল সাহেব যেটা বোঝায়, সেটাই তাকে বুঝতে হয়, সেটুকুই তাকে জানতে হয়। এখন উকিল সাহেব ভালো করে বললেন না, বুঝলেন বা এমন কথা বলে দিলেন যে, হয়তো তার পকেট থেকে আরও বেশি কিছু টাকা খসল। অবশ্য আমি আশা করি, উকিল সাহেবরা কিছু মনে করবেন না। এখানে অনেকে আবার আমাদের আইনজীবী আছেন, তারা যেন কিছু মনে না করেন। কিন্তু এটা বাস্তবতা। যে রায়টা পেলেন, এ রায়টা পাওয়ার পর এই সাধারণ মানুষটা তিনি তো নিজে পড়ে দেখে বুঝতে পারছেন না। তিনি যার ওপর নির্ভর করছেন তিনি যেভাবে বলেছেন সেইটাই তাকে বলতে হচ্ছে। তাতে যদি তার কিছু পকেট খালি হয়, সেটাও হচ্ছে। কাজেই তাকে তো জানার আর বোঝার সুযোগটাও দিতে হবে, এদিকটাও তো বিবেচনা করতে হবে। তবে এখন যেমন নিম্ন আদালতে ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বাংলা ভাষায় রায়ের। এখন উচ্চ আদালতেও, আমরা আশা করি যে ভবিষ্যতে, যে দীর্ঘদিনের একটা চর্চা চট করে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তু তাও, আমরা আশা করি, নিশ্চয়ই সেটা লিখবে, তা ওই জিনিসটাই ভাষান্তর করা হোক, অনুবাদ করা হোক, অনুবাদের বিরুদ্ধে আমরা নই। কিন্তু অন্ততপক্ষে বাংলা ভাষায় লিখলে পরে যারা অন্তত একটা ন্যায়বিচার চাচ্ছিল, তারা কী বিচার পেল, অন্তত সেটুকু তো তারা জানতে পারবে, সে সুযোগটা তো তারা পাবে। কাজেই এ চর্চাটা আমাদের থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে যে, বাংলা ভাষায় কথা বলি কিন্তু এই বাংলা ভাষা এখন অনেকটা ইংরেজি মানে ইংরেজি টোনে বলা, এক ধরনের কেমন যেন একটু বিকৃত করে বলার কেমন একটা চর্চা শুরু হয়ে গেছে। সেটা কেন, আমি জানি না।

কারণ, হ্যাঁ, যেমন আমাদের একটা অসুবিধা ছিল আমরা ’৭৫-এর পর দেশে ফিরতে পারিনি। ছয়টা বছর আমাদের বিদেশের মাটিতে থাকতে হয়েছিল। ছেলেমেয়েগুলো বিদেশেই লেখাপড়া শিখতে বাধ্য হয়েছিল; যেখানে বাংলা শেখার এতটুকু সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমি রেহানা, আমরা, কিন্তু সবসময় চেষ্টা করেছি আমাদের ছেলেমেয়েদের ওই সীমিত অবস্থায় এবং হোস্টেলে পড়াশোনা করেছে, প্রতি সপ্তাহে বাংলায় চিঠি লিখতাম; আর ছুটিতে এলে বাংলা শেখাতে চেষ্টা করতাম; যাতে অন্তত কিছুটা মাতৃভাষাকে তারা জানুক, তারা সুযোগ পাক। তারা বিদেশে লেখাপড়া শিখেও অন্তত যতটুকু বাংলা বলতে পারে বা যতটুকু শুদ্ধভাবে বলতে পারে, আমরা তো দেখি যে, বাংলাদেশে থেকে হয়তো বেশ ভালো একটু ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে তারাও যেন বাংলা বলতেই চায় না, বলতেই পারে না; বলতে গেলেও একটু বিকৃত করে বলে। সেখানেই খুব দুঃখ লাগে। আমরা তো বাধ্যতামূলকভাবেই আমাদের বিদেশে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু যারা এখানেই মানুষ হচ্ছে, তাদের মধ্যেই এই বিকৃতি থাকবে কেন? আমি আবারও বলছি আমি কিন্তু ভাষা শেখার পক্ষে, যতটুকু ভাষা শেখা যায়, আমরা নিশ্চয়ই সেটাকে স্বাগত জানাই; আমরা এটা চাই। আমি এটা মনে করি যে, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের একেবারে শুরু থেকেই যে ইংরেজি ভাষা ইংরেজি ভাষা দ্বিতীয় ভাষা। পৃথিবীর সব দেশেই এটা আছে, একটি মাতৃভাষা শিক্ষা আর একটি দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষা। এই দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ এখন দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ। এখন আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। গ্রামে বসেই আমার ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন দেশের ভাষা শেখে কিন্তু তারা অনলাইনে অনেক অর্থ উপার্জন করছে। সেই সুযোগটা সৃষ্টি করতে হবে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যে ভাষা আমার মায়ের ভাষা, যে ভাষায় আমরা কথা বলি, যে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, সেই ভাষার চর্চাটা তো আমাদের থাকতে হবে। সেই শিক্ষাটা পেতে হবে; সেটা পরিবার থেকে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ পরিবার থেকে না করলে কিন্তু এটা কখনই শেখা যায় না। কাজেই সেটাও আমাদের করতে হবে। কাজেই সেটাই আমরা চাই।

আজকে আমরা বলব যে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আমরা যে কাজগুলো করেছিলাম, মাঝখানে আবার পথ হারিয়ে যায় বাংলাদেশ অর্থাৎ ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত। আমরা আবার সরকারে আসার পর, আজকে বাংলাদেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগুলো আবার মানুষের সামনে তুলে ধরা, মুক্তিযুদ্ধের যে আত্মত্যাগের কাহিনী সেই কাহিনীগুলো বলা এমন একটা সময় দেখেছি যে, অনেকেই নিজে মুক্তিযোদ্ধা বলতে সাহস পেতেন না। একটি সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা, এ কথাটা লিখতে সাহস পেতেন না। কারণ তাহলে চাকরি পাবেন না। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! ’৭৫ সালের পর, জাতির পিতাকে হারাবার পর এই অবস্থা বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল, তখন ছিল রাজাকারদের দাপট। অন্তত আজকে, ২০০৮-এর নির্বাচনে আমরা জয়ী হয়েছি, এরপর ২০১৪-এর নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে অগ্নিসন্ত্রাস করেও ঠেকাতে পারেনি। আমরা সরকারে এসেছি এই দীর্ঘ সময় নয় বছর সরকারে থাকার পরে অন্ততপক্ষে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আজকে মানুষ গর্ববোধ করে, এখন আর ভীতসন্ত্রস্ত হয় না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগুলো আবার সামনে এসেছে। মানুষ বলার সুযোগ পাচ্ছে, লেখার সুযোগ পাচ্ছে। অন্তত সেই আত্মবিশ্বাসটা ফিরে এসেছে। এই আত্মবিশ্বাসটা যেন হারিয়ে না যায়। এমন কোনো অন্ধকারে যেন আবার আমরা না পড়ি যে, আবার আমাদের সেই অন্ধকারে চলে যেতে হবে, আবার মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে হবে, সেই পরিবেশ যেন ভবিষ্যতে আর কোনো দিন বাংলার মাটিতে না আসে, সে ব্যাপারে সবাইকে আমি বলব সচেতন থাকতে হবে। সবাইকে সচেতন থাকতে হবে, আবার যেন আমরা সেই ধরনের বিপদে না পড়ে যাই। কারণ যাদের হৃদয়ে পাকিস্তান, থাকে বাংলাদেশে, সবরকম আরাম-আয়েশ ফল ভোগ করবে এই দেশে, আর অন্তর আত্মাটা পড়ে থাকবে ওই দেশে, আর তাদের জন্য আবার কাঁদে পাকিস্তান, পেয়ারে পাকিস্তান! কাজেই এই পেয়ারে পাকিস্তানওয়ালাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষা করে চলতে হবে। এটাই আমার আবেদন থাকবে দেশবাসীর কাছে।

আমরা আমাদের ভাষা আন্দোলনের এই শহীদদের রক্তের পথ বেয়েই কিন্তু লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ওই ১৫ আগস্টের খুনিদেরও পার্লামেন্টে ভোট চুরি করে বসানো হয়েছিল। আর স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী, যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে, সাজা কার্যকর হয়েছে, তাদের যারা মন্ত্রী বানিয়েছিল, আমার লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তাদের হাতে যারা তুলে দিয়েছিল, জাতি যেন কোনো দিন তাদের ক্ষমা না করে। সেটাই আমার জাতির কাছে আবেদন। যারা আমার মা-বোনকে রেপ করেছে, যারা গণহত্যা চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগ করেছে, লুটপাট করেছে সেই যুদ্ধাপরাধী আর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে, তাদের বিচারের রায় আমরা কার্যকর করেছি। যারা এদের মর্যাদা দিয়েছিল, যারা এদের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিল তাদের ব্যাপারে জাতিকে সচেতন থাকতে হবে। তাদের কিন্তু জাতি কোনো দিন ক্ষমা করতে পারে না। ক্ষমা করবে না, জাতির কাছে আজকের দিনে আমার এটাই আবেদন থাকল।

আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। আমি আশা করি যে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আজকে জাতির পিতার নেতৃত্বেই এই বাংলাদেশ। আমরা নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে একটা স্বীকৃতি পেয়েছিলাম, আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছি অর্থাৎ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে একধাপ এগিয়েছে। বাঙালি জাতি আজকে মর্যাদা পেয়েছে। এই অগ্রযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে, শহীদদের প্রতি এটা আমাদের অঙ্গীকার যে, এই অগ্রযাত্রা আমরা অব্যাহত রাখব।

[মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-প্রদত্ত ভাষণ।]