ঋণের সুদহারে লাগাম টানল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

ঋণের সুদে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ঠেকাতে লাগাম টেনে ধরল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক নির্দেশনার মাধ্যমে সুদহার পরিবর্তনের বিভিন্ন নিয়ম-নীতি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এখন থেকে কোনো ব্যাংক বছরে একবারের বেশি সুদহার বাড়াতে পারবে না। ওই একবার বাড়ানোর ক্ষেত্রেও অন্তত তিন মাস আগে গ্রাহককে নোটিশ দিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণের সুদহার বৃদ্ধির বিষয়টিকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে ঋণ ও আমানতে সুদহারের ব্যবধান কমিয়ে ৪ শতাংশে নামানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনাটি গতকাল থেকেই কার্যকর হয়েছে।

গতকাল বুধবার আলাদা দুটি সার্কুলারের মাধ্যমে এসব নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) কমানোসহ বিভিন্ন সুবিধার পর সুদহার নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে এ উদ্যোগ নিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবশ্য বর্তমানে ঋণ আমানতের মধ্যেকার সুদহারে সর্বোচ্চ ব্যবধান ৫ শতাংশে সীমিত রাখার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা থাকলেও অনেক ব্যাংক তা মানছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্প্রেড ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়াটা ভালো। এর ফলে আমানতের সুদহার খুব একটা কমবে না। অথচ ঋণের সুদ কমে আসবে। তবে এটা কার্যকর করাটা বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন জোট বেঁধে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন দাবি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। ফলে যে করেই হোক সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে। তিনি বলেন, সুদহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে নোটিশ দেওয়া বা অন্যান্য যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলোও ভালো। গ্রাহক আগে থেকে জানার ফলে তার মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

তারল্য ব্যবস্থাপনার ওপর চাপকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাস ধরে সুদহার ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। সুদহার কমানোর লক্ষ্যে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে গত এপ্রিলে ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) হার সাড়ে ৬ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়। রেপোর সুদ ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশে নামানো হয়। আর সরকারি আমানতের ২৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হলেও সুদহার না কমায় বিভিন্ন মহল থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার বিষয়ে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের তাগাদা দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, কোনো ঋণের মঞ্জুরিপত্রে সুদহার অপরিবর্তনশীল উল্লেখ থাকলে ওই ঋণের সুদহারে সংশ্নিষ্ট ঋণের মেয়াদকালে ঊর্ধ্বমুখী কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুদহার কমালেও বাড়ানো যাবে না। আর মঞ্জুরিপত্রে সুদহার পরিবর্তনশীল উল্লেখ থাকলে ওই ঋণের ক্ষেত্রে বছরে সর্বোচ্চ একবার সুদ বাড়ানো যাবে। বাড়নোর ক্ষেত্রে মেয়াদি ঋণের বেলায় প্রতিবার অনধিক শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ এবং চলতি মূলধন ও অন্যান্য ঋণের বেলায় প্রতিবার অনধিক ১ শতাংশ মাত্রায় পরিমিত রাখতে হবে। সুদহার বৃদ্ধির বিষয়ে সংশ্নিষ্ট গ্রাহককে কমপক্ষে তিন মাস আগে নোটিশ দিতে হবে। গ্রাহককে অবহিত না করে কোনো ঋণের সুদহার বৃদ্ধি করা যাবে না। এ ছাড়া নতুন ঋণ মঞ্জুরির সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি থেকে এর আগে ইস্যু করা সার্কুলারের নির্দেশনা বলবৎ থাকবে।

এতে আরও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় আর্থিক বাজার সুদহারে সাম্প্রতিক বৃদ্ধির সূত্রে নতুন ঋণ মঞ্জুরি ছাড়াও বিদ্যমান ব্যাংক ঋণ হিসাবগুলোতেও আকস্মিক অযৌক্তিক মাত্রায় উচ্চতর সুদহার নির্ধারণের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঋণগ্রহীতাদের পরিশোধ সামর্থ্যের ও আর্থিক সঙ্গতির ওপর অনভিপ্রেত চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি বিনিয়োগ ও উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং নতুনভাবে খেলাপি ঋণ সৃষ্টির ঝুঁকি এড়ানোর লক্ষ্যে সব তফসিলি ব্যাংকের জন্য এসব নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।

জানতে চাইলে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান  বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার বিষয়ে এখনই তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্নিষ্টরা জানান, অনেক আগে ব্যাংকগুলো কোন খাতে কী পরিমাণ সুদে ঋণ দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা নির্ধারণ করে দিত। তবে আইএমএফের পরামর্শে আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুদহার পরিবর্তনের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে শুধু রফতানি খাতে ৭ শতাংশ এবং কৃষিতে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারিত আছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো প্রতি মাসে একবার করে সুদহার পরিবর্তন করতে পারে।

স্প্রেড ৪ শতাংশে সীমিত রাখার নির্দেশ :বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে জারি করা দুটি সার্কুলারের মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ড ও ভোক্তাঋণ ছাড়া অন্যান্য খাতে ঋণ এবং আমানতের গড়ভারিত সুদহারের ব্যবধান বা স্প্রেড নিম্নতর এক অঙ্ক তথা শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার নির্দেশনা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের ঋণের সুদহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করছে। ঋণের সুদহার অযৌক্তিক মাত্রায় বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। এ পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদনশীল খাতসহ বিভিন্ন খাতে ঋণের সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণের লক্ষ্যে ক্রেডিট কার্ড ও ভোক্তাঋণ ছাড়া অন্যান্য খাতে ঋণ এবং আমানতের গড়ভারিত সুদহারের ব্যবধান ৪ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো।