নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় পার করেছে বাংলাদেশের সমুদ্র ও নৌ-সীমার নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। জনবল সীমাবদ্ধতার মাঝেও উপকূলীয় এলাকার জানমাল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ, অবৈধ কর্মকাণ্ড দমনে কাজ করছে কোস্ট গার্ড। উপকূলের মানুষের কাছে এখন আস্থার নাম কোস্ট গার্ড। উপকূলে নজরদারি নিরাপত্তা বাড়াতে কোস্ট গার্ডকে পেশাগত ভিত্তি দিতে নিজস্ব জনবল নিয়োগের পরিকল্পনা করছে সরকার। হচ্ছে কোস্টাল সার্ভিল্যান্স সিস্টেমও।
কোস্ট গার্ড ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশ পেয়েছে দেশের সমান আয়তনের বিশাল সমুদ্র এলাকা ও সম্পদ। বর্তমান সরকারের ভিশন অনুযায়ী এই সমুদ্রসম্পদকে কাজে লাগিয়ে ব্লু ইকোনমিতে দেশকে এগিয়ে নিতে অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে কোস্ট গার্ড। সে জন্য পেশাগত ভিত্তি দরকার, দরকার নিজস্ব জনবল।
কোস্ট গার্ড সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থা ও আইএমও কর্তৃক এক লাখ ৭২ হাজার ৬২৭ বর্গ কিলোমিটার সাগর এলাকায় সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ পরিচালনায় দায়িত্ব পালন করছে কোস্ট গার্ড। যেখানে দেশি-বিদেশি সমুদ্রসীমার চারদিক সুরক্ষার দায়িত্বও পালন করছে কোস্ট গার্ড।
কোস্ট গার্ড দেশের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে জাতীয় মৎস্য পুরস্কার-২০১৮ পেয়েছে। ২০১৮ সালে ১৩টি দেশের কোস্ট গার্ড বাহিনী ও মেরিটাইম সংস্থার প্রধানদের নিয়ে হেটস অব এশিয়ান কোস্ট গার্ড মিটিং সফলভাবে শেষ করায় বিশ্বজুড়ে কুড়িয়েছে সুনাম।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বাহিনী ১০ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা সমমূল্যের বিভিন্ন ধরনের পণ্য জব্দ করেছে। এক হাজার ২৩৯ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য জব্দ করেছে। আটক করেছে চার হাজার ৩৮৩ জন অপরাধীকে। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙরে চুরি ও ডাকাতি ছিল শূন্য। যা আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থা রিক্যাপের রিপোর্টে উঠে এসেছে। যা মেরিটাইম জগতে কোস্ট গার্ডের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।
তবে সম্প্রতি সৃষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে দেশের জলসীমায় যে অবৈধ প্রবেশ চলছে তা ঠেকাতে কোস্ট গার্ড সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে কোস্ট গার্ডের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জনবল। যদিও জনবল দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কোস্ট গার্ডের এগিয়ে চলায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে কোস্ট গার্ড সদর দফতরে বাহিনীটির ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কোস্ট গার্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বদ্ধপরিকর শেখ হাসিনার সরকার। ইতোমধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় কোস্ট গার্ডকে যুগোপযুগী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বাহিনীতে পরিণত করতে চারটি অস্ত্র প্যাট্রল ভেসেল সংযোজন করা হয়েছে, দুটি ইতোমধ্যে সংযুক্ত হয়েছে। দেশীয় শিপইয়ার্ডসমূহের পাঁচটি ইনসোর প্যাট্রল ভেসেল ও দুটি ফাস্ট প্যাট্রল বোট বাহিনীতে মহড়ায় সংযুক্ত হয়েছে।
শিগগিরই আরও দুটি ইনসোর পেট্রল ভেসেল, একটি ফ্লটিং ক্রেন সংযুক্ত হবে, দুটি ডাকবোট, ১২টি হাইস্পিড বোট সংযোজনের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া জাপান কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ২০টি রেসকিউ ও চারটি পুলসন কন্ট্রোল বোট বাহিনীর মহড়ায় যুক্ত হবে। বাহিনীর চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কোস্ট গার্ড ঘাঁটি স্টেশন, আউটপোস্টসহ বেশ কিছু অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে ও আরও হবে।
তিনি বলেন, দেশের উপকূলে ১০টি রাডার স্টেশন দ্বারা কোস্ট গার্ডের সার্ভেল্যান্স সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে দেশের সমগ্র উপকূলীয় এলাকাকে কার্যকরী নজরদারি আনা হবে। এর ফলে দেশীয় সমুদ্রসীমায় কার্যকরী টহল প্রদান, গভীর সমুদ্রে সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অপারেশন পরিচালনা, চোরাচালান প্রতিরোধ, সমুদ্রপথে মানবপাচার রোধ, উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগ পরবর্তীতে ত্রাণবিতরণ, দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজে অগ্নিনির্বাপণ এবং পরিবেশদূষণ রোধসহ সামগ্রিক সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে সমগ্র উপকূলীয় এলাকাকে কার্যকরী নজরদারি বৃদ্ধি সম্ভব হবে। এই লক্ষ্যে বিশেষায়িত এই বাহিনীর পেশাগত ভিত্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিজস্ব জনবল নিয়োগ করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, বাহিনীতে আধুনিক জাহাজ, হোভারক্রাফট, ড্রোন, মেরিটাইম প্যাট্রল এয়ারক্রাফট ও হেলিকপ্টার সংযোজন করা হবে।
কোস্ট গার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এম আশরাফুল হক বলেন, এ বাহিনীর নিরলস প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বন্দরে চুরি-ডাকাতি শূন্যের কোঠায় নেমেছে যা আন্তর্জাতিক সংস্থা রিক্যাপের রিপোর্টে উঠে এসেছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ও বাহিনীর সকল সদস্য দেশপ্রেমের চেতনা সমুন্নত রেখে তাদের অটুট মনোবল, নিরলস কর্মস্পৃহা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধমে ‘ব্লু ইকোনমি’ এবং রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কোস্ট গার্ড।