রোজার পর ঈদকে কেন্দ্র করে স্বাভাবিক নিয়মেই অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়ে। ছোট-বড় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে লেনদেন হয় ব্যাপক হারে। বিশেষ করে চাঙা হয়ে উঠে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা। এবার জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ চাকার গতি আরও বেড়েছে। কেননা রাজনীতিকরা উপহার, ফিতরা ও যাকাতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর বাইরে প্রবাসীরাও রেমিটেন্সের পরিমাণ বাড়িয়েছেন। প্রিয়জনকে খুশি করতে যে যার মতো করে অর্থ ব্যয় করছেন। ফলে ভোগ-বিলাসে বিনিয়োগ হয়েছে বিশাল পরিমাণ অর্থ। এতেই ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি জমে উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছর অর্থনীতির আকার বেড়েছে ১০-১৫ শতাংশ হারে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও বেড়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ ভোগ-বিলাসে বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর বাইরে ভ্রমণ পিপাসু মানুষতো আছেই। অনেকে জমানো টাকা খরচ করে ঈদ উদযাপন করেন। আর এই টাকার হাত বদলেই অর্থনীতির উপখাতগুলো জমে উঠে। ফলে বেড়ে যায় প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছরই ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষ ব্যাংক আমানত তোলার পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। আগের বছরও এমনটাই দেখা গেছে। গত বছর ঈদ হয়েছে জুন মাসে। ওই মাসে ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে সাড়ে ১৭ শতাংশ হারে টাকা মানুষের পকেটে চলে যায়। যা তার আগের মাসে ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। ঈদ শেষে এই টাকা আবার ব্যাংকিং চ্যানেলে চলে আসে। এভাবে প্রতি বছর ঈদকে কেন্দ্র করে টাকার হাতবদল হতে থাকে।
বাড়তি যোগ দেড় থেকে দুই লাখ কোটি টাকা
এফবিসিসিআই সূত্র মতে, ঈদকে কেন্দ্র করে নিয়মত প্রবাহের বাইরে অর্থনীতিতে যোগ হয় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু পোশাকের বাজারে যোগ হয় ৩২ হাজার কোটি টাকা। ইফতার-সাহরিতে যোগ হয় ৪ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা, ভোগ্য পণ্যে ২৪ হাজার কোটি টাকা, যাকাত-ফিতরা ও ধনীদের দান খয়রাতে ৬০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, ঈদকেন্দ্রিক নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়ার প্রবণতায় পরিবহনে যোগ হয় ৬শ’ কোটি টাকা। ভোগ-বিলাস ও ভ্রমণে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা অর্থনীতিতে যোগ হয়।
এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি বেতন-বোনাস যোগ হয় অর্থনীতিতে। দেশে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২০ লাখ। ঈদে বোনাস বাবদ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা পায় তারা। এটি ঈদকেন্দ্রিক বিভিন্ন খাতে খরচও হয়।
এছাড়া দেশব্যাপী ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী রয়েছে, যাদের বেতন-বোনাস ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের বোনাস ৩ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ সরসরি চলে যায় গ্রামে। অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স তো আছেই। প্রিয়জনের ঈদের আনন্দে যেন ভাটা না পড়ে এজন্য রেমিটেন্সের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন তারা। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স থেকে ঈদ অর্থনীতিতে যোগ হয়। এসব হিসাব মিলিয়ে ঈদ অর্থনীতির আকার দাঁড়ায় প্রায় দেড় থেকে ২ লাখ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গার্মেন্ট উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এবার ঈদে গ্রার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধের ব্যাপারে সব মালিকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শুক্রবার নাগাদ অধিকাংশ কারখানা শ্রমিদের বোনাসসহ বেতন পরিশোধ করা হবে। একই সঙ্গে, তারা যেন নির্বিঘ্নে বাড়ি যেতে পারে, সেজন্য ধাপে ধাপে ছুটি দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতিসহ দেশের উন্নয়নে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কারণ এই খাতের ৯৫ শতাংশ শ্রমিক গ্রাম থেকে আসা। তারা প্রায় সবাই বাড়িমুখী হয়। ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে দিতেও এদের অর্থ বেশি হাতবদল হয়।
এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনে অংশ নিতে চায় এমন নেতারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঈদকে কেন্দ্র করে অর্থ-কড়ি খরচ করছেন। যাকাত, ফিতরা, উপহারের পরিমাণ বাড়িয়েছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপি, জাতীয় পার্টি এমনকি ছোট দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীরা অর্থ ব্যয় করছেন। ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ করে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। উপহার হিসেবে শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপিসহ ঈদ সামগ্রী বিতরণ করছেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, মুসলিম বিশ্বে ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি চাঙা হয়। টাকার হাতবদলের মাধ্যমে টাকার প্রবাহ বাড়ে। তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে শহর থেকে গ্রামে টাকা পৌঁছে যেতে সময় লাগে না। মানুষ নতুন জামা-কাপড়, ঘর সাজানো, ভ্রমণ তথা ভোগ বিলাসে অর্থ ব্যয় করে। এতে অর্থনীতিতে বাড়তি অর্থ যোগ হয়। যা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো।