ই-কমার্সে ডিজিটাল বিজনেস আইডি: আগ্রহ-শঙ্কার দোলাচলে উদ্যোক্তারা

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

ই-কমার্সে অনিয়ম ও প্রতারণা বন্ধে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিফিকেশন (ডিবিআইডি) নম্বর দেওয়া শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে এই ডিবিআইডি। যার মধ্যে ছয়টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও পাঁচটি ফেসবুক পেজভিত্তিক ব্যবসা বা এফ কমার্স প্রতিষ্ঠান। তবে ডিবিআইডির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এখনো ধন্দে রয়েছেন উদ্যোক্তারা। নিবন্ধন প্রক্রিয়ার কিছু বিষয়ও তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি (আরজেএসসি) মাই গভ অ্যাপস’র মাধ্যমে ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনার জন্য ডিজিটাল বিজনেস আইডি দেওয়া শুরু করে মন্ত্রণালয়।

জানা যায়, মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান ডিবিআইডির জন্য আবেদন করেছে। ডিবিআইডি নিতে আগ্রহী হলেও উদ্যোক্তারা এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এখনো ধন্দে। এছাড়া নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরছেন তারা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি পাইলটিং পর্যায়ে, আরও যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আগামী মার্চের পর ডিবিআইডির নিবন্ধন ছাড়া ফেসবুক বা অন্য কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্য বেচাকেনা বন্ধের চিন্তা-ভাবনা থাকলেও এখনই কঠোর হচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা।

ডিবিআইডি কী? কীভাবে নিতে হবে?

বর্তমানে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করতে হয়। অনলাইন বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যবসায় নিতে হয় ট্রেড লাইসেন্স। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স থাকলেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো মনিটর করার কোনো ব্যবস্থা নেই।

ডিবিআইডি হলো সেই মনিটরিং ব্যবস্থা। একজন উদ্যোক্তা তার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সরকারি ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হবেন। এই অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তৈরি হবে ইউনিক নম্বর বা আইডেন্টিটি, যাকে বলা হচ্ছে ডিবিআইডি।

গত বছর একাধিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং গ্রাহক-মার্চেন্টদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। আস্থার সংকটে পড়ে এ খাত। এ অবস্থায় সরকার ই-কমার্স পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন ও ইকমার্স উদ্যোক্তাদের নিবন্ধনের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসি-২০২০ নামে প্রণয়ন করে একটি নির্দেশিকা। যাতে পণ্য অর্ডার নেওয়া, ডেলিভারি ও অর্থ পরিশোধ সংক্রান্ত নীতিমালা তুলে ধরা হয়। এছাড়া ই-কমার্স খাতে জবাবদিহি ও প্রতারণা ঠেকাতে সেপ্টেম্বর মাসে একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে সময়ই সিদ্ধান্ত হয় এ খাতের উদ্যোক্তাদের ইউনিক বিজনেস আইডেনটিফিকেশনের (ইউবিআইডি) মাধ্যমে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হবে।

যদিও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউবিআইডির নাম বদলে করা হয় ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিফিকেশন (ডিবিআইডি)।

যেভাবে রেজিস্ট্রেশন করবেন

মাই গভ ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের ট্যাবটি সামনে আসবে। এরপর নাম, মোবাইল নম্বর, ইমেইল নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। সফলভাবে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে ছবি, স্বাক্ষর, আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি, আয়কর নিবন্ধন নম্বরের সত্যায়িত কপি, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন নম্বরের সত্যায়িত কপি, ট্রেড লাইসেন্সের সত্যায়িত কপি, পরিচালকদের জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি, বাড়ির মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি, ভাড়া অফিসের ক্ষেত্রে বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিকের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির দলিলের সত্যায়িত কপি, ভ্যাট নিবন্ধন নম্বরের সত্যায়িত কপি, স্থানীয় চেয়ারম্যান/ওয়ার্ড কমিশনার/গণ্যমান্য ব্যক্তির সুপারিশ প্রভৃতি কাগজপত্র অনলাইনে সাবমিট করে ডিবিআইডির জন্য আবেদন করতে হবে।

ওয়েবসাইট ছাড়াও ডিবিআইডি নামে একটি অ্যাপ চালু করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই অ্যাপটির মাধ্যমেও উদ্যোক্তারা নিবন্ধন করতে পারবেন।

উদ্যোক্তারা আবেদন করতে পারবেন বিনামূল্যে। আবেদন করার ৩০ দিনের মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে উদ্যোক্তাকে এই আইডি নম্বর দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। যাতে গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করা যায় সেজন্য সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিজনেস আইডি দেওয়ার মাধ্যমে ই-কমার্স আওতায় এসেছে একটি নতুন পদ্ধতির। এতে ই-কমার্সে প্রতারণা অনেক কমে আসবে। এ বিষয়ে গ্রাহকদেরও সচেতন থাকতে হবে।

ডিবিআইডির জটিলতাও শিগগির সমাধান হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে ই-ক্যাবের তালিকাভুক্ত ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৬০৯টি। এছাড়া মোট ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৫০০টি। ফেসবুক কমার্সের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাবের) জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, ‘ডিবিআইডি নিয়ে এখনো অনেক কাজ বাকি। আমরা জানতে পেরেছি এ পর্যন্ত সাড়ে চারশোর বেশি আবেদন পড়েছে। এটা নিলে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া যাবে কি না কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করা যাবে কি না সেটা নিশ্চিত নয়। এই নিবন্ধন নেওয়ায় কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে সেটা জানা-বোঝা না গেলে উদ্যোক্তারা এটা কেন নেবে।’

ডিবিআইডির জটিলতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘কোম্পানি আইন বা ট্রেড লাইসেন্সের অবস্থান কী হবে সেটা ঠিক হয়নি। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে এটা চললেও, এটা নিয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বসছি। এখানে বিভিন্ন ডকুমেন্ট সত্যায়িত করার কথা বলা হয়েছে। এটা খুবই পীড়াদায়ক। এরকম সমস্যা সমাধান করতে আরও বসা দরকার।’

শুভাশিষ রায় নামে ইক্যাবের এক সদস্য ও উদ্যোক্তা বলেন, ‘সব ডকুমেন্টের সত্যায়িত কপি আপলোড করতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা সই করলেই হবে, নাকি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার কাছ থেকে সত্যায়িত করিয়ে নিতে হবে এ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।’

উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের জন্য বিষয়টা অত্যন্ত পজেটিভ জিনিস। এমন না যে ডিবিআইডি নিলে আর ট্রেড লাইন্সেন্স নিতে হবে না। এটার আওতায় থাকলে সরকারের ডাটাবেজে নাম থাকলো। বলা যায় লিগ্যালাইজড করা হলো।

উদ্যোক্তারা ডিবিআইডি নিতে আগ্রহী জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের আন্ডারে যারা আছে তাদের নিবন্ধন নিতে সমস্যা হলে সাহায্য করছি। আমরা একটা ডেডিকেটেড ডেস্ক দিয়ে দিতে চেষ্টা করছি। যাতে উদ্যোক্তারা সার্ভিসটি নিতে পারেন।

একাধিক ই-কমার্স উদ্যোক্তা ও এফ কমার্স উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এরই মধ্যে তারা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন। তারা বলছেন, সরকারি নিবন্ধনের আওতায় এলে এ খাতের প্রতারণা কমবে। তবে ডিবিআইডি ব্যবহার করে সরকারি বিভিন্ন সেবা পেতে চান তারা।

ইকমার্স ও এফ কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য ডিজিটাল বিজনেস ইউনিক আইডি চালুর সিদ্ধান্ত স্বাগত জানিয়ে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম সুখ ডটকমের চিফ ইনফরমেশন অফিসার (সিআইও) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এ উদ্যোগের ফলে এই খাতে যারা ব্যবসা করবেন, তাদের জবাবদিহির জায়গাটা আরও বেড়ে গেলো। যেসব উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী এই খাতে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন, তাদের জন্য আরও ভালো হলো। যার সুফল সাধারণ গ্রাহক সবচেয়ে বেশি পাবে। আমরা চাই ই-কমার্সে যারাই ব্যবসা করবে তারা গ্রাহকদের জন্য ক্যাশ অন ডেলিভারি, দ্রুত ডেলিভারি ও ইজি রিটার্ন পলিসির মতো নানান সুবিধা দেবে। ফলে কেউ অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এলে তারা সুবিধা করতে পারবে না। এই ইউনিক আইডি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করছি।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ডিজিটাল প্রতারণা বন্ধে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শুরু হয়েছে ডিজিটাল বিজনেস আইডি দেওয়া। ই-কমার্স পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই এ আইডি গ্রহণ করলে প্রতারণার সুযোগ থাকবে না।