ইয়াহুর পরিণতি হবে ফেসবুকের?

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

চিরদিন কারও এক রকম যায় না। যে জাহাজটিকে বলা হচ্ছিল কখনোই ডুববে না, সবাইকে হতবাক করে সেই টাইটানিকও ডুবেছে। একসময় যে ইয়াহু ছিল ইন্টারনেটের সমর্থক তিন দশকের কম সময়ে, সেই ইয়াহু হারিয়ে যেতে বসেছে। যে নকিয়া ছিল মোবাইল ফোন দুনিয়ার শীর্ষে, তারা এখন প্রত্যাবর্তনের পালা অতিক্রম করছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কী হবে ফেসবুকের? ফেসবুকও কি সময়ের তালে হারিয়ে যাবে? ফেসবুকের ভবিষ্যৎ কি তবে ইয়াহুর মতো হতে চলেছে?

ইকোনমিস্ট তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ইকোনমিস্ট বলছে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষের এখন ইন্টারনেটের ইতিহাসে চোখ বোলানোর সময় চলে এসেছে। ফেসবুকের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনদাতারা সরে যাচ্ছে। ফেসবুকের ব্যবসার মডেল বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। ফেসবুক ঘিরে ব্যবহারকারীদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তবে কি ফেসবুকের পতন আসন্ন? ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে এখন পর্যন্ত ‘চতুর’ আর ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন’ বলা যায়। এখন পর্যন্ত সব চাপ সামলে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অর্থ-ক্ষমতায় বশে রেখে তরতর করে এগিয়ে চলেছেন। কিন্তু ফেসবুকের এই এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে এখন বড় প্রতিবন্ধকতা আসতে শুরু করেছে। নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, ভুয়া খবর ছড়ানো, ব্যবহারকারীর তথ্য নিরাপত্তার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। জাকারবার্গকে সরানোর প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। এ চাপ সামলাতে পারবেন তো জাকারবার্গ?

ফেসবুক–আসক্তিতে যা হচ্ছে ও হতে পারে
ইকোনমিস্ট বলছে, ফেসবুককে এখন বলা হচ্ছে বড় নেশা। তুলনা করা হচ্ছে সিগারেট ও তামাকের সঙ্গে। সিগারেটের নেশার চেয়েও মারাত্মক ফেসবুকের আসক্তি। একবার এ আসক্তি পেয়ে বসলে সর্বনাশ। সোনার দেহ মাটি হবে। একাকিত্ব বাসা বাঁধবে মনে। বাড়বে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কোনো কিছু চোখের আড়াল হওয়ার ভয় কাজ করবে। অন্যের সাফল্যে হিংসা হবে। ঈর্ষা জাগবে। তৈরি হবে আত্মহত্যার প্রবণতা। প্রযুক্তি দুনিয়ার বড় বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা জনসমক্ষেই ফেসবুকের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলছেন। এর আসক্তি কাটাতে পরামর্শ দিচ্ছেন। ফেসবুকের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে ক্লাউড কম্পিউটিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সেলসফোর্সের প্রধান নির্বাহী মার্ক বেনিওফ যেমনটা বলেছেন, ‘ফেসবুক হলো নতুন সিগারেট। আপনারা জানেন, এটা আসক্তি সৃষ্টি করে। এটা আপনার জন্য ভালো নয়। আপনাকে অনেক মানুষ এটা ব্যবহার করার জন্য টেনে আনবে। কী ঘটবে, আপনি বুঝতেই পারবেন না। তাই সরকারের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কী ঘটছে, সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি।’ শিশুদের ওপর ফেসবুকের প্রভাব নিয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেন বেনিওফ। তাঁর ভাষ্য, সিগারেট যেভাবে সমাজের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে, ফেসবুকও সেভাবেই প্রভাব ফেলছে। কয়েকটি গবেষণায় এ বিষয়টি উঠে এসেছে।

গত বছর থেকেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে বেশি অভিযোগ আসা শুরু করে। সমস্যা ঠিক না করে ফেসবুকের সমালোচকদের ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কর্তৃপক্ষ। সমালোচকেরা ফেসবুককে আসক্তিকর, গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে একে নিয়ন্ত্রণের কথা বলতে শুরু করেন। তবে ফেসবুকের সঙ্গে মাদক বা সিগারেটের তুলনার চেয়েও কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ফেসবুককে। অনেকেই বলছেন, ফেসবুক এখন পতনের প্রান্তে। ইয়াহুর পরিণতি হবে ফেসবুকের। ইন্টারনেট দুনিয়ার রাজা পড়ে থাকবে আস্তাকুঁড়ে।

ইন্টারনেট দুনিয়ার একসময় রাজা ছিল ইয়াহু। ইন্টারনেটের শুরুর প্রথম দিকে ওয়েবসাইট ডিরেক্টরি হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল ইয়াহুর। গত শতকের শেষের দিকে ইন্টারনেটের সমার্থক ছিল ইয়াহু। ডটকম যুগের সূচনার দিকে এর বাজারমূল্য ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছিল। কিন্তু ইয়াহুকে অধিকাংশ সময় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বদল, মিডিয়া, নাকি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, এ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে হয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারনেট জগতের এখনকার বড় প্রতিষ্ঠান ফেসবুককে কেনার সুযোগ হেলায় হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ভেরাইজনের কাছে বিক্রি হয়ে যায় ইয়াহু।

আজ যে দুর্দশায় পড়েছে ফেসবুক, বছর খানেক আগেও ফেসবুকের এমন দুর্গতির কথা কেউ ভাবতেই পারেনি। সামাজিক যোগাযোগের সাইট হিসেবে ফেসবুক ও এর অধীনে থাকা ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের মেসেঞ্জারের ব্যবহার বাড়ছিল। কিন্তু এ বছরের জানুয়ারি মাস থেকে হঠাৎ চিত্র বদলাতে শুরু করল। ফেসবুক ঘিরে তৈরি কিছু বিতর্ক, ভুল বোঝাবুঝি আর কিছু ভুল পদক্ষেপে ফেসবুক নিয়ে নেতিবাচক খবরের ঢেউ উঠল। সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল, ফেসবুক ব্যবসা বাদে অন্য কিছু ভাবেনি।

২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ঠেকাতে ফেসবুক যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। ফেসবুক থেকে ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়াই যুক্তরাজ্যের নির্বাচনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে নয় কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সে কথা স্বীকার করে নেয় ফেসবুক। ওই ঘটনা ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এরপর আবার ফেসবুকের নিরাপত্তা ত্রুটি কাজে লাগিয়ে পাঁচ কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য বেহাত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নাড়া দেয়। আস্থার সংকটে পড়ে যায় ফেসবুক।

গত নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেসবুক আর এর প্রতিষ্ঠাতা জাকারবার্গের জন্য আরও বড় ধাক্কা হয়ে আসে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়টি নিয়ে ফেসবুক যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। এ ছাড়া ফেসবুক ডিফাইনার্স পাবলিক অ্যাফেয়ার্স নামের একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান (পিআর ফার্ম) ভাড়া করেছে, যাতে ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমালোচকদের নামে কুৎসা ছড়ানো হয়। ফেসবুকের সমালোচকদের বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপ ঘিরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিনিয়োগকারীরা জাকারবার্গের ওপর চাপ বাড়াতে থাকেন। তাঁকে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী পদ থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান ফেসবুকের বড় একটি অংশের শেয়ারের মালিক ট্রিলিয়াম অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জোনাস ক্রোন।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের পর থেকেই ফেসবুক নিয়ে নেতিবাচক কথাবার্তা চলছে। সমালোচকেরা ধুয়ে দিচ্ছেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গকে। নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, ভুয়া খবর ঠেকানোর বিরুদ্ধে অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা, তথ্য ফাঁস কেলেঙ্কারির মতো নানা বিষয়ে সমালোচনা চলছে। জাকারবার্গের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ উঠছে। এরই মধ্যে সিএনএনের লরি সেগালকে এক বিশেষ সাক্ষাৎকার দেন মার্ক জাকারবার্গ। তিনি বলেন, তিনি ও তাঁর ডান হাত বলে পরিচিত শেরিল স্যান্ডবার্গের ফেসবুকে থাকা জরুরি। তিনি ফেসবুকের চেয়ারম্যান পদটি ছাড়বেন না। এমনকি শেরিলও তাঁর জায়গা থেকে নড়বেন না। তাঁরা ফেসবুকে রদবদল করতে কাজ করছেন।

ইকোনমিস্ট বলছে, এখনই ইয়াহুর সঙ্গে অবশ্য ফেসবুকের তুলনা করা ঠিক হবে না। ইয়াহু যখন সাফল্যের চূড়ায় ছিল, তখন তারা ব্যবসা বড় করার এবং ফেসবুকের মতো লাভজনক অবস্থায় নিতে পারেনি। এ ছাড়া প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রও তখন ছিল ভিন্ন। ইয়াহুর পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গুগলের উঠে আসা। এর বাইরে ২০১২ সাল থেকে ইয়াহুর প্রধান নির্বাহী মারিসা মেয়ার তাদের প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপনদাতা ও কর্মীদের আস্থা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। ফেসবুকের ক্ষেত্রে বড় সুবিধা হলো তাদের এখন সত্যিকার অর্থে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এর বাইরে ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য অ্যাপগুলো কিনে রেখেছে ফেসবুক। জনপ্রিয় ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ তাদের অধীনেই আছে। এ ছাড়া প্রয়োজন ও ট্রেন্ড অনুযায়ী নতুন নতুন অ্যাপ ও সেবা বাজারে ছাড়ছে তারা।

তবে যাঁরা ইয়াহুর পতন দেখেছেন, তাঁরা ফেসবুকের পতনের দৃশ্যও কল্পনা করতে পারেন। এর সঙ্গে মিলও দেখতে পান। একটি মিল হচ্ছে শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি। ইয়াহুর ক্ষেত্রে মেয়ারকে নিয়োগের আগে ইয়াহুতে তিন বছরে চারজন প্রধান নির্বাহী বদল হয়েছিল। তবে ফেসবুকের অধিকাংশ শেয়ারের নিয়ন্ত্রণ ও ভোট দেওয়ার ক্ষমতা জাকারবার্গের হাতে থাকায় তাঁকে সহজে ফেসবুক থেকে সরানো যাবে না। তিনি নিজেও ফেসবুক ছাড়তে চান না। কিন্তু ফেসবুকের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা কিন্তু ফেসবুক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এ বছরেই ইনস্টাগ্রামের দুই প্রতিষ্ঠাতা, অকুলাসের প্রধান কর্মকর্তা, হোয়াটসঅ্যাপের সহপ্রতিষ্ঠাতা, ফেসবুকের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও আইনি পরামর্শক তাঁদের পদ ছেড়েছেন।

ডিজিটাল বিজ্ঞাপন খাতের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, যেভাবে ফেসবুক থেকে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ঘোষণা দিয়ে সরে যাচ্ছেন, তাতে ইয়াহুর মেরিসা মায়ার পূর্ব অবস্থার দৃশ্যায়ন মনে হচ্ছে। এর বাইরে ফেসবুক নিয়ে নেতিবাচক খবরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের মনোবলের ক্ষতি করছে।

ফেসবুকের একজন কর্মী ফেসবুকের পরিস্থিতিকে ‘ভয়ংকর’ বলে উল্লেখ করছেন। ফেসবুকের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের অবহেলার অভিযোগ তুলছেন প্রতিষ্ঠানটির একজন সাবেক কর্মী। মার্ক লুসি নামের ওই কর্মীর বরাতে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ফেসবুক তাদের কর্মীবাহিনীতে কৃষ্ণাঙ্গদের অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ফেসবুকের জন্য এখন দুটি ঝুঁকি। একটি হচ্ছে ফেসবুকের তারকা কর্মীরা যেসব প্রতিষ্ঠানে বিতর্ক কম, সেখানে চলে যেতে পারেন। আরেকটি হচ্ছে ফেসবুকের শেয়ারের দাম পড়ার কারণে কর্মীদের আকর্ষণীয় বেতনে ধরে রাখা।

 

ফেসবুক কি চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে?

ফেসবুককে এখনই শেষ বলা যাবে না। এখনো শক্তিশালী ফেসবুক। কিন্তু এর ভারসাম্য এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আগামী বছরগুলোতে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে ফেসবুককে। এ ছাড়া মানুষ যেভাবে ডিজিটাল পণ্য ব্যবহারের ধরন বদলায়, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে। এ বিষয়গুলো ফেসবুকের মুনাফার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। দুই বছর আগে ফেসবুকে ১৮ বছরের বেশি বয়সী তরুণেরা যে পরিমাণ সময় কাটাত, এখন তা ৩১ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এতে বিজ্ঞাপন দেখানোর সুযোগ কমে আসবে। তবে তাদের হাতে আছে ইনস্টাগ্রাম। ফেসবুকের বিপদের বন্ধু হতে পারে তাদের ইনস্টাগ্রাম। ফেসবুক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিজ্ঞাপনদাতারা ইনস্টাগ্রামে যাচ্ছেন। তবে ইনস্টাগ্রামে বেশি বিজ্ঞাপন দেখানো হলে ব্যবহারকারীরা বিরক্ত হবেন। সে ঝুঁকিও রয়েছে। তাই ফেসবুকের মতো পরিণতি হতে পারে ইনস্টাগ্রামের ক্ষেত্রেও।

ফেসবুক এখন নতুন ফিচারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এখন ফেসবুকের ব্যবহারকারীরা বেশি সময় কাটাচ্ছেন স্টোরিজ ফিচারে। এ ফিচারটিতে ফেসবুকের জন্য বিজ্ঞাপনের সুযোগ কম। স্টোরিজ ফিচারটি স্ন্যাপচ্যাটের কাছ থেকে নেওয়া। ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত আপডেট দেখার এ ফিচারে কোনো ল্যান্ডিং পেজ নেই বলে বিজ্ঞাপন দেখাতে ঝামেলায় পড়তে হবে ফেসবুক। ফেসবুকের অধীনে থাকা মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুকের জন্য আয় আনছে কম। এ মুহূর্তে এ সেবায় তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ সেবাটিতে তারা বিজ্ঞাপন দেখানোর পরিকল্পনা করছে। এ পরিকল্পনা ঘিরেই হোয়াটসঅ্যাপ প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে ঝামেলা বেধেছে জাকারবার্গের। সরে দাঁড়িয়েছেন জন কউম। মানুষ যেখানে ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করছে সেখানে বিজ্ঞাপন দেখাতে গেলে ভাবনাচিন্তা করতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষের কনটেন্ট দেখার ধরন বদলে ব্যক্তিগত যোগাযোগের দিকে যাওয়াটা ফেসবুকের ব্যবসার জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি হিসেবে মনে করা হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে জাকারবার্গ অবগত আছেন। এর আগে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ডেস্কটপ থেকে মোবাইলে স্থানান্তরের বিষয়টির সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, পরিবর্তনের এ সময়ে তাদের মুনাফার গতি কমে যাবে। মানুষ এখন স্টোরিজ ও মেসেজিংয়ে ঝুঁকে পড়বে। কিন্তু ফেসবুকের মূল সাইটের চেয়ে এসব পণ্য কতটা আকর্ষণীয় হবে, তা এখনো প্রমাণিত নয়।

ফেসবুকের রাজনৈতিক বিতর্ক এখনো বিজ্ঞাপনদাতাদের আগ্রহ কমায়নি। তবে আগামী বছরগুলোয় এর প্রভাব পড়তে পারে। অনেক বিজ্ঞাপনদাতা মনে করেন, ফেসবুক একরোখা নীতি নিয়ে এগোচ্ছে। বিজ্ঞাপনদাতাদের বড় দুটি অভিযোগের একটি হচ্ছে ফেসবুকে অর্থ খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবহারকারীকে ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ তাদের বিজ্ঞাপন ব্যবহারকারীরা ঠিকমতো দেখছেন না। দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে গ্রাহককে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে ফেসবুক।

নিউইয়র্কের পিভোটাল রিসার্চের ব্রায়ান উইজার বলেন, ফেসবুকে বিজ্ঞাপনদাতাদের ভুয়া প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। তারা যে পরিমাণ ১৮-৩৪ বছর বয়সী ব্যবহারকারীর কাছে বিজ্ঞাপন দেখানোর কথা বলছে, সে তথ্য যথাযথ নয়। ভুয়া দর্শক দেখানো নিয়ে ফেসবুকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।

এ ছাড়া ফেসবুকের পোস্ট কতজন দেখবে বলে প্রদর্শন করা হয়, তা ভুল বলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন। ফেসবুক যেসব তথ্য-উপাত্ত দেখায়, সেগুলো তাদের পক্ষে যায়। যেসব তথ্য বিজ্ঞাপনদাতাদের দেখানো হয়, তার অর্ধেক সুবিধাও তাঁরা পান না।

ফেসবুক নিয়ে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে রাজনীতিবিদদেরও। ফেসবুকের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনতে আইন করার চিন্তাভাবনাও চলছে।

এখন মার্ক জাকারবার্গ ও শেরিল স্যান্ডবার্গের ওপর বিজ্ঞাপনদাতা ও রাজনীতিবিদদের আস্থা ফেরানোর চাপ। ফেসবুক বিশ্বাসযোগ্য এবং এটা সময় ও অর্থ ব্যয়ের উপযোগী, তা তাঁদের প্রমাণ করে দেখাতে হবে। তাঁরা যদি আস্থা ফেরাতে না পারেন, তবে ফেসবুকের শেয়ারের দাম পতনের ধারা অব্যাহত থাকবে। সবচেয়ে বড় চাপে থাকবেন প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) শেরিল। তাঁকে আগামী বছর পদ ছাড়তে হতে পারে। জাকারবার্গ অবশ্য নিজের ও শেরিলের ফেসবুকে থাকার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের ক্রমবর্ধমান চাপে কতটুকু অনড় থাকতে পারবেন, তা দেখার বিষয়। জাকারবার্গ নিশ্চয়ই ইয়াহুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চান না!