ইয়াবার টাকায় মাজার উন্নয়ন

:
: ৬ years ago

রাজধানীর অদূরে দোহারের জয়পাড়ার চৌধুরীপাড়া এলাকায় সজীব চৌধুরী ওরফে শামসুজ্জামান চৌধুরীর মাজার ঘিরে চার বছর ধরে আত্মগোপনে থেকে কৌশলে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল মোহাম্মদপুরের শীর্ষ দুই মাদক ব্যবসায়ী। এর বিনিময়ে ইয়াবা ব্যবসার টাকায় সজীব চৌধুরীর মাজারে ৩৫ লাখ টাকার উন্নয়ন কাজ করে দেয় তারা। শুধু তাই নয়, সজীব চৌধুরীর ভাই রাজীব চৌধুরীকে জমি কিনতে আরও ২৫ লাখ টাকা দেয়। এই দুই মাদক ব্যবসায়ী হলো- মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের জয়নাল আবেদীন পাচু ওরফে জয় ও তার স্ত্রী ফারহানা আক্তার পাপিয়া। মাদক জগতে এই দম্পতি ইয়াবার ‘রাজকুমার ও রাজকুমারী’ নামে পরিচিত।

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর  লালবাগের সুবল দাস লেন থেকে পাচু ও তার স্ত্রী পাপিয়াকে বিশ হাজার ইয়াবা বড়িসহ গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। তাদের দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মাজার ঘিরে মাদক ব্যবসার এমন চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে। তদন্ত সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র  এসব তথ্য জানায়।

পুলিশের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ রাজধানীর শীর্ষ যে ৮২ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা তৈরি করা হয়, তাতে পাচু ও তার স্ত্রী পাপিয়ার নাম ছিল। এ ছাড়া নারী মাদক ব্যবসায়ীদের যে পৃথক তালিকা করা হয়েছিল, সেখানেও পাপিয়া ছিল। ২০০৭ সালে মোহাম্মদপুরে কানা সুমনের সিডির দোকানে সহিদ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় পাচুর। সহিদের সঙ্গে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়াত জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা পাচু। সহিদ তাকে নিয়মিত একটি প্যাকেট দিত। আর সেই প্যাকেট সহিদের কথামতো নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিত পাচু। এর বিনিময়ে পাচুকে দেওয়া হতো ৫০০ টাকা।

পরে পাচু জানতে পারে সহিদের ওই প্যাকেটে থাকত ইয়াবা। নিয়মিত টাকা পাওয়ার লোভে ও পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে সহিদের সঙ্গ তখনও ছাড়তে পারেনি সে। ২০০৯ সালে সহিদ ও পাচু র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে। জামিনে বেরিয়ে ২০১০ সালে প্রেম করে পাচু বিয়ে করে মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লার বাসিন্দা পাপিয়াকে। বিয়ের পর তারা কক্সবাজারে হানিমুনে যায়। ওই সময় তাদের সঙ্গে সহিদও ছিল। হানিমুনে গিয়ে কক্সবাজারে পাচুর পরিচয় হয় জনৈক রফিকের সঙ্গে। পরে সহিদকে বাদ দিয়ে রফিকের মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসা শুরু করে পাচু ও পাপিয়া।

২০১১ সালে জেনেভা ক্যাম্পের ইশতিয়াক দিনে ২০-৩০ পিস ইয়াবা বড়ি পাচুর কাছ থেকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। পরের বছর ইশতিয়াক নিজেই ব্যবসা চালাতে থাকে। তার পর থেকেই জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পাচু ও ইশতিয়াকের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ২০১৩ সালের দিকে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয় ইশতিয়াক। এরপর সেখানে পাচুর ব্যবসায় ভাটা পড়তে থাকে। ২০১৪ সালে স্ত্রী পাপিয়াকে নিয়ে জেনেভা ক্যাম্প ছাড়ে পাচু। তারা আস্তানা তৈরি করে দোহারের জয়পাড়ায়। সেখানে সর্বশেষ আঙ্গুর মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকত আলোচিত এ দম্পতি।

দোহারে তারা মূলত সজীব চৌধুরীর মাজারে আত্মগোপনে থাকত। মাজারের কাছেই আঙ্গুর মিয়ার বাড়ি। ইয়াবা ব্যবসার অর্থ দিয়ে পাচু ও তার স্ত্রী এরই মধ্যে মাজারের ৩৫ লাখ টাকার উন্নয়নকাজ করে দিয়েছে। মাজারের পীরের বাড়ির গেট ও বিভিন্ন স্থাপনায় টাইলস বসানো হয়েছে। অর্থ সহায়তার বিনিময়ে মাজারের ভেতরেই পাচুর জন্য একটি ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। সেখানে স্ত্রীকে নিয়ে থাকত সে। আর মাঝে মধ্যে আঙ্গুর মিয়ার ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠত। পাচু জানায়, অনেক আগে থেকে তার শ্বশুর ওই মাজারের ভক্ত ছিলেন। সেই সূত্র ধরে ওই মাজারে যায় সে।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া জানায়, ২০১০ সালে মোহাম্মদপুর কিশোরালয় বালিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে সে। প্রেম করে পাচুকে বিয়ে করে। পরে উভয়ের পরিবার বিয়ে মেনে নেয়। বিয়ের পর কিছুদিন তারা জেনেভা ক্যাম্পে ছিল। পরে ইশতিয়াকের সঙ্গে তার স্বামীর দ্বন্দ্ব হলে তারা সেখান থেকে দোহারে মাজার ঘিরে আত্মগোপন করে। পাপিয়া এও জানায়, নবম শ্রেণিতে পাড়ার সময় কয়েকজন বান্ধবীর মাধ্যমে নেশার জগতে পা বাড়ায় সে।

পুলিশ জানায়, গত ২৬ এপ্রিল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সজীব চৌধুরীর মাজারে পাচু ও তার স্ত্রীকে ধরতে অভিযান চালায় পুলিশ। তবে অভিযানের পরপরই মাজারের কিছু লোকজন তাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে র‌্যাবের একটি দল সজীব চৌধুরীর মাজারে অভিযান চালায়। অভিযোগ ছিল, ওই মাজার ঘিরে মেলার আড়ালে মাদকের আখড়া বসানো হয়। ঢাকার একজন প্রভাবশালী ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্ম করেও দীর্ঘদিন ধরে পার পাচ্ছিল তারা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দোহারে মাজার ঘিরে অপকর্মের অভিযোগ বেশ পুরনো। ২০১৭ সালে দোহারের লটাখোলায় ডা. মতিউর রহমান ওরফে হজবাবা পীর ও সেন্টু পীরের মাজার বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারা ওই মাজারে হজ আয়োজনের প্রতারণা করে আসছিল।

সিটিটিসির এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, মোহাম্মদপুরের শীর্ষ দুই ইয়াবা কারবারি দোহারে একটি মাজার ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছিল। ওই মাজারের বর্তমান পীর সজীব চৌধুরী। এ চক্রে যারা জড়িত, সবাইকে আইনের আওতায় নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মাজারের পীর সজীব চৌধুরী বলেন, পাচুকে প্রথমে মাজারে নিয়ে আসে তার শ্বশুর। তবে পাচু ও তার স্ত্রী মাদক ব্যবসায় জড়িত, তা জানা ছিল না। পাচু বলত, সে সিগারেটও খায় না। পরে তার খারাপ চরিত্রের কথা জানতে পেরে মাজার থেকে বের করে দেওয়া হয়। এর পরও মাঝে মধ্যে মাজারে এসে একটি ঘরে বসত সে। হাফপ্যান্ট পরে ঘুরত। পরে ওই ঘরও তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। তবে দোহারে দানশীল ব্যক্তি হিসেবে পাচুর পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু কখনও পাচুর কাছ থেকে মাজার কর্তৃপক্ষ অনুদান নেয়নি। পাচুর শ্বশুর মাজারে অনুদান হিসেবে কয়েক লাখ টাকা দিয়েছিল। পাচুকে জমি কিনে দেওয়া বাবদ বায়না হিসেবে সজীব চৌধুরীর ভাই রাজীব চৌধুরীকে ২৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা জানান সজীব।

সজীব চৌধুরী আরও জানান, তিনি অসুস্থ, হাসপাতালে আছেন। তাই কারা পাচু ও তার স্ত্রীকে অভিযানের সময় পার করে দিয়েছে, তা জানা নেই।

দোহার থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেন, মাজার ঘিরে আমাদের নজরদারি রয়েছে। বেআইনি কাজের তথ্য পাওয়া গেলে অভিযান চালানো হয়।