ইসির সায়, এমপিরা নামবেন প্রচারে

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে সায় দিয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আচরণবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফলে স্থানীয় সরকারের অন্য স্তরে না হলেও সিটির ভোটে প্রচারে নামার সুযোগ পাচ্ছেন সাংসদরা। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটের প্রচারে বিধিনিষেধ আরোপেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে. এম. নুরুল হুদার সভাপতিত্বে বৈঠকে চার কমিশনার, ইসি কার্যালয়ের সচিবসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে প্রচার ও ভোটকেন্দ্রে সাংসদদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন কমিশন ২০১০ সালে পর্যায়ক্রমে স্থানীয় সরকারের সব স্তরেই এমপিদের প্রচারে নামার সুযোগ বন্ধ করে দেয়।

যদিও বর্তমান ইসির এই পদক্ষেপে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নির্বাচন বিশ্নেষকরা। তাদের মতে, এই পদক্ষেপ ইসিকে আগামী সংসদ নির্বাচনে বড় ধরনের বিপদের মুখে ফেলতে পারে। কারণ তাদের সম্পর্কে জনমনে বিরূপ ধারণার জন্ম নেবে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সবার জন্য সমান সুযোগের যে কথাটি বলা হয়, তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গতকালের বৈঠকে এমপিদের প্রচারে নামার সুযোগের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে বিবেচনায় নেওয়া হলেও কোন প্রক্রিয়ায় তাদের সুযোগ দেওয়া হবে বা কোনো শর্তারোপ করা হবে কি-না তা চূড়ান্ত হয়নি। বিদ্যমান আচরণবিধি পর্যালোচনা করে দ্রুত একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে কমিশন সভায় উত্থাপনের জন্য নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমকে প্রধান করে একটি কমিটিও করা হয়।

বৈঠক শেষে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ তার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা জানান। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের এ প্রস্তাবে ইসি ইতিবাচকভাবে আচরণবিধি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আচরণবিধি পর্যালোচনা কমিটিকে দ্রুত সুপারিশ দিতে বলা হলেও

কোনো সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে তফসিল ঘোষিত গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের প্রচারে এমপিরা এ সুযোগ পাচ্ছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না।

ইসির এ সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একজন এমপি তার নির্বাচনী এলাকায় প্রচণ্ড ক্ষমতাধর, প্রভাব ও প্রতিপত্তির মালিক। তাকে নির্বাচনী প্রচারে নামার সুযোগ দিলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না। যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা ইসি মোকাবেলা করতে পারবে না। এ সিদ্ধান্তে ইসি নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবে।

গত ১২ এপ্রিল ইসি কার্যালয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল সিটির ভোটে এমপিদের প্রচারে নামার সুযোগ দাবি করেন। গতকাল এই ইস্যুতে জরুরি কমিশন সভা আহ্বান করে ইসি। গত ১৭ এপ্রিল সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপি ইসি কার্যালয়ে গিয়ে সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করে। তবে ইসি সচিব জানান, গতকালের বৈঠকে বিএনপির দাবি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এ বিষয়ে পরে কোনো বৈঠকে আলোচনা হতে পারে।

বৈঠক সূত্র জানায়, এমপিদের প্রচারের সুযোগ দিলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঝুঁকি নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। একাধিক কমিশনার প্রস্তাব করেন, বিদ্যমান বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও আচরণবিধি লঙ্ঘন ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে তারা গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে স্কুলের ক্লাস বন্ধ করে সমাবেশের ঘটনাও তুলে ধরেন। এ পর্যায়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা যাচাই তদন্ত করার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। ইসি সচিবের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ ঘটনার তদন্ত করা হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিদ্যমান আচরণবিধিতে ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির’ নির্বাচনী প্রচারে নামার সুযোগ নেই। ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির’ সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- ‘প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী বা তাদের সমপদমর্যাদার কোনো ব্যক্তি, সংসদ সদস্য এবং সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বুঝাবে।’

এতে আরও বলা হয়েছে- সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন-পূর্ব সময়ে নির্বাচনী এলাকায় প্রচার বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তবে তিনি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ভোটার হলে কেবল ভোট দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে যেতে পারবেন। তাদের এলাকায় অবস্থানের বিষয়ে বিধিনিষেধের বিষয়টি বিদ্যমান আইনে স্পষ্ট নেই।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনী প্রচারের অভিজ্ঞতায় এমপিদের অংশগ্রহণের বিষয়টি সুখকর নয়। ১৯৯৪ সালে মাগুরায় উপনির্বাচনে প্রত্যেকটি কেন্দ্রে একজন করে সাংসদকে দায়িত্ব দিয়েছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি। ওই নির্বাচন নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ছাড়াও ২০০৯ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর পরই দেশজুড়ে উপজেলা নির্বাচনে এমপিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন কমিশন স্থানীয় সরকারের সব ধরনের নির্বাচনে এমপিদের প্রচার নিষিদ্ধ করে। ২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার পরে আচরণবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন রকিব কমিশন। কিন্তু ওই সময়ে উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনার কারণে সমালোচনার মুখে থাকা ওই কমিশনের সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

ইসির এই উদ্যোগ সম্পর্কে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২০১০ সালে এই বিধান চালুর সময় সব রাজনৈতিক দলের মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল। একজন এমপির তার নির্বাচনী এলাকায় কতটা প্রভাব, তা মনে হয় বর্তমান ইসি বিবেচনায় নিতে পারেনি। তিনি বলেন, এমপি পদ লাভজনক কি-না এ নিয়ে অসংখ্য বিতর্ক হয়েছে। খুলনার আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার খালেক এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন। ইসি যদি এখন তাদের সরকারি সুবিধাভোগী মনে না করে, তাহলে তার পতদ্যাগ করার প্রয়োজন ছিল না।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কতটা বিবেচনাপ্রসূত তা অবশ্যই বর্তমান ইসি সদস্যদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত। কারণ সামনে সংসদ নির্বাচন। এই ছোটখাটো নির্বাচনে নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে না পারলে ভবিষ্যতে তাদের মানুষ কেন বিশ্বাস করবে।

গতকালের বৈঠক শেষে ইসি সচিব আরও বলেন, তারা পর্যালোচনা করে দেখেছেন, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে কারা পড়েন। এমপিরা এর আওতায় থাকলেও ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার তুলনায় সিটি করপোরেশন একটি বিশাল এলাকা। এসব এলাকায় একাধিক সাংসদ বসবাস করেন। তফসিল ঘোষণার পরে তাদের নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। আইনে তাদের শুধু ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে এমপিদের নিজ এলাকার বাইরে থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলোচনা হয়েছে দাবি করে হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, সংসদ সদস্যরা কোনো অফিস হোল্ড করেন না। সরকারি গাড়িও ব্যবহার করেন না।

গাজীপুর ও খুলনা সিটির তফসিল ঘোষণার পরে কেন এ উদ্যোগ- এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, আচরণবিধি মাঝে মধ্যে হালনাগাদ করতে হয়। আগে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা না হলেও এখন হচ্ছে। সে সময় এক ধরনের হলেও এখন আরেক ধরনের প্রেক্ষাপট।

সরকারি দলের চাপে ইসির এমন সিদ্ধান্ত কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দলই ইসির স্টেকহোল্ডার। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়েই ইসিকে কাজ করতে হয়। তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো বিবেচনায় নিতে হয়।

হলফনামায় তথ্য যাচাইয়ে ইসির না

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর হলফনামায় দেওয়া তথ্য নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ সম্পর্কে ইসি সচিব বলেন, একজন প্রার্থী নিজের দায়-দায়িত্ব নিয়েই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হলফনামায় তথ্য দেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ ইসির নেই।

সচিবের এমন বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে বা তথ্য গোপন করলে প্রার্থিতা বাতিলের যেখানে বিধান রয়েছে, সেখানে ইসি সচিবের বক্তব্য বিস্ময়কর। তাহলে হলফনামা জমা নেওয়ার প্রয়োজন কী? তিনি বলেন, খুলনায় দুই প্রার্থীর মধ্যে যে বিতর্ক চলছে তা অত্যন্ত ইতিবাচক। ইসি এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পারে। কারণ হলফনামায় দেওয়া তথ্য জনসমক্ষে প্রচার ইসির জন্য বাধ্যতামূলক এবং তা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আইনে রয়েছে।